খুঁজুন

Thursday, March 30, 2017

কমলের একাত্তর / বাবু ফরিদী (১৩)




 মন্দিরের ভেতর উচ্চস্বরে কীর্তন চলতে থাকে অমরদাসহ আমরা চারজন হাত-মুখে জল দিতে পুকুরের দিকে এগিয়ে যাই হাতমুখ ধুয়ে কেবল উপরে উঠতে যাচ্ছি, এমন সময় দেখি শ্রীঅঙ্গন পোস্ট অফিসের সামনে দিয়ে আমাদের দিকে ছুটে আসছে একটি সাঁজোয়া যান আরও কয়েকটি ছুটে যাচ্ছে শহর অভিমুখে
 
কিছু বুঝে ওঠার আগেই, অমরদা সেদিকে এগিয়ে যাচ্ছিলো আমি তাঁর গলায় আমার পড়নের কাপড়ের আঁচল পেচিয়ে তাঁকে ফেলে দিলাম মাটিতে তারপর সর্বশক্তি নিয়োগ করে তাঁকে টেনে নিয়ে গেলাম পুকুরের পূর্বপাড়ে অমরদা কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে গেলেন

ততক্ষণে শ্রীঅঙ্গন মন্দিরের সামনে এসে গেছে সাঁজোয়া গাড়ি আমরা উপুড় হয়ে পড়ে রইলাম সেখানে, আর উপলব্ধি করতে থাকলাম পরবর্তী ঘটনাগুলো চারজন মিলিটারি মন্দিরের ভেতর থেকে নয়জন সাধুকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে এলো মন্দির সংলগ্ন চালতেগাছের নীচে একজন মিলিটারি সেখানে আগে থেকেই পজিশন নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো সাধুদের সেখানে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করানো হলো তারপর গুলির শব্দ হলো ধ্বনিত হলোজয় জগদ্বন্ধু হরি! জয় জগদ্বন্ধু হরি!’ কিছুক্ষণ পরপর একটি একটি করে মোট বারোটি গুলির শব্দ শোনা গেলো আর্তনাদ করে আকাশ-পাতাল আন্দোলিত করে ধুলোয় লুটিয়ে পড়লো ব্রহ্মচারীরা আর এই প্রথমবারের মতো থেমে গেলো কীর্তন!
                  
                   হরি পুরুষ জগদ্বন্ধু মহাউদ্ধারণ
                   চারি হস্ত চন্দ্র পুত্র হা কীট পতন

সন্ধ্যা যখন নামলো, ততক্ষণে সব শেষ শ্রীঅঙ্গনের আটটি পোষা কুকুর তখন চিৎকার করে তাদের আহাজারি প্রকাশ করছে ছুটে এলেন হরিবলদা কুকুরগুলো তাঁকে বারবার লাশগুলোর কাছে নিয়ে যাবার জন্য ব্যাকুলতা প্রকাশ করছিল হরিবলদা ভয়ে ভয়ে এগিয়ে গেলেন সেদিকে নিজের চোখে দেখলেন স্বজনদের ক্ষতবিক্ষত চেহাড়াকীর্তনব্রত ব্রহ্মচারী, কানাইবন্ধু ব্রহ্মচারী, নিদানবন্ধু ব্রহ্মচারী, ক্ষিতিবন্ধু ব্রহ্মচারী, চিরবন্ধু ব্রহ্মচারী, বন্ধুদাস ব্রহ্মচারী, গৌরবন্ধু ব্রহ্মচারী এবং রবিবন্ধু ব্রহ্মচারী রক্তে একাকার চালতেতলা রবিদার প্রাণ তখনও যায়নি তাঁর মুখে গুলি লেগে জিহ্বা বেরিয়ে এসেছে তির তির করে নড়ছে জিহ্বা! অথচ ভাগ্যক্রমে নন্দ সাধু সুযোগ বুঝে নীচের একটি প্রকোষ্ঠের সিলিংয়ে আত্মগোপন করে প্রাণে বেঁচে যান

তারপর জীবিতরা দিগ্বিদিক জ্ঞানশূণ্য হয়ে কয়েক ভাগে ভাগ হয়ে সরে পড়লাম কারণ আমাদের আশংকা ছিল, সন্ধ্যার পর আবারও হয়তো মিলিটারিরা এখানে ঢুকতে পারে আমি আর অমরদা চেয়ারম্যান আনসার মোল্যার বাড়ির দিকে ছুটলাম বিহারি কলোনি পার হয়ে যাবার সময় ওদের বাড়িতে কোনো পুরুষের দেখা মিললো না, আছে শুধু মেয়েরা তাদের কেউ কেউ অমরদারকে দেখে খবর জানতে চাইলো কেউ কেউ আমাকে দেখিয়ে তাদের কোকা দৃষ্টির ইঙ্গিতে দিচ্ছিলো অমরদা আমাকে আড়াল করে এগিয়ে গেলো চেয়ারম্যান বাড়ির দিকে

উঠোনে পা দিতেই দেখতে পেলাম চেয়ারম্যানের বড় ছেলে দিলুকে ওর কাছে চেয়ারম্যান সাহেবের খোঁজ জানতে চাইলে, জানালো, তিনি ঘরেই আছেন অমরদা আমাকে উঠোনে দাঁড় করিয়ে ঘরের দিকে ছুটতেই দেখলেন, চেয়ারম্যান সাহেব লাঠি হাতে এগিয়ে আসছেন রুগ্ন শরীরে তাঁকে খুব বিমর্ষ দেখাচ্ছিলো তিনি অমরদার মুখে সব কথা শুনে অনতিবিলম্বে পালিয়ে যেতে পরামর্শ দিলেন তবে যাবার আগে ইসমাইল মাতুব্বরের বাড়ি হয়ে যেতে বললেন

ইসমাইল মাতুব্বরের বাড়ির উঠোনের এক কোণে একটা হেরিকেন ঝুলন্ত অবস্থায় দেখতে পেলাম এগিয়ে যেতেই, হেরিকেনের আলো-আঁধারিতে দেখলাম, গ্রামের মানুষ দলা পাকিয়ে বসে আছে ইসমাইল মাতুব্বরের সাথে কথা বললেন অমরদা কথা শুনে মাতুব্বর সাহেব তৎক্ষণাৎ আমাদের চকের ভেতর দিয়ে তুলাগ্রাম পালিয়ে যাবার পরামর্শ দিলেন এবং পথ দেখিয়ে দেওয়ার জন্য একজন সঙ্গীও দিয়ে দিলেন

আমরা সেই রাতেই তুলাগ্রাম থেকে চক পাড়ি দিয়ে ভোরে চন্ডীপুর চলে আসি পরে হরিবলদার সাথে দেখা হলে জানলাম, উনি সেই রাতে শ্রীঅঙ্গনেই ছিলেন সন্ধ্যার পর নাকি আবারও মিলিটারির গাড়ি শ্রীঅঙ্গনে ঢোকে মিলিটারিরা অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে সার্চলাইটের আলোয় সমস্ত শ্রীঅঙ্গনের ভেতর-বাহির খুটিয়ে খুটিয়ে দেখেছে তখন হরিবলদা ছিলেন মস্ত বড় ব্রাউলিয়া ফুল গাছের ঝোপের ভেতর লুকিয়ে

পরদিন ভোরে নাকি মিউনিসিপ্যালিটির ট্রাক এসে লাশগুলো তুলে নিয়ে গেছে তখনও রবিবন্ধুদার দেহে প্রাণ ছিল কলোনি পাড়ার বলাই নাকি লাশটি নামিয়ে রেখেছিলো কিন্তু কিছুক্ষণের ভেতর তিনিও মারা যান

        বিষ্ণুর কথাগুলো শুনতে শুনতে কমলের বুকের মধ্যে যেন এক খণ্ড পাথর চেপে বসলো মাথাটা ঝিমঝিম করতে লাগলো মুহূর্তে দুঃখ-শোকের স্থলে কমলের বুক ভয়-ত্রাসে ভর্তি হয়ে ওঠে পাশাপাশি, দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকে জিঘাংসার আগুন  


           (চলবে)

বাকি অংশ পড়তে নিচের 'Older posts' লেখার ওপর ক্লিক করুন>

No comments:

Post a Comment