ক্রমশ রাত বাড়তে
থাকে ।
কিন্তু গ্রামীণ নিস্তব্ধতা
নামে না । কি
শহর-পালানো মানুষ,
কি গ্রামের মানুষ--
সবার মনে উৎকণ্ঠা,
উদ্বেগ। না
জানি কী হয়!
কি জানি কী
হয়!
কেউ কেউ জেলা
বোর্ডের রাস্তায়
জটলা করছে আর
বিড়ি ফুঁকছে। বলা
যায় অঘোষিত পাহারা। যদি
মিলিটারির আগমনবার্তা
জানা যায়, তাহলে
ঝোড়-জঙ্গলে পালাবে। কেউ
কেউ থেকে বেরিকেড
দিচ্ছে দেখলে ওরা
গ্রাম জালিয়ে দেবে। রাস্তায়
জটলা, বাড়ি বাড়ি
জটলা। নানা
কথা-- কোনটা বাতাসে
ভেসে আসা, কোনটা
আবার মনগড়া।
কমল বিশুদার সাথে
রাস্তায় গিয়ে
কয়েক বাড়ি ঘুরে
অনেক অভিজ্ঞতাই অর্জন
করলো। এক
সময় ডেরায় ঢুকে
শুয়ে পড়লো। বাবা-মা
উঠোনে জ্যাঠা-জ্যেঠি
ও প্রতিবেশীদের
সাথে খেজুরপাতার পাটিতে
বসে স্বপ্ন-দুঃস্বপ্নের
মধ্যে প্রহর গুনছে,
আর কমল বিছানায়
ছোট ছোট ভাইবোনদের
পাশে শুয়ে শহরের
কথা ভাবে, ভাবে
বিগত দিনের কথা। ৭ই
মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের
অংশ বিশেষ মনে
পড়ে—
‘... যার যা
কিছু আছে তাই
নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা
করতে হবে। রাস্তাঘাট
বন্ধ করে দিতে
হবে।
---আমি যদি হুকুম
দেবার নাও পারি,
আমার সহকর্মীরা যদি
নাও থাকেন, আপনারা
আন্দোলন চালিয়ে
যাবেন, ... কিন্তু
হুশিয়ার, একটা
কথা মনে রাখবেন
আমাদের মধ্যে শত্রু
ঢুকেছে, ছদ্মবেশে তারা
আত্মকলহ সৃষ্টি
করতে চায়। বাঙালি-অবাঙালি,
হিন্দু-মুসলমান সবাই
আমাদের ভাই, তাদের
রক্ষা করার দায়িত্ব
আমাদের।
---হাতের কাছে যা
আছে তাই নিয়ে
প্রস্তুত থাকুন। রক্ত
যখন দিয়েছি, রক্ত
আরও দেবো। এদেশের
মানুষকে মুক্ত
করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ। এবারের
সংগ্রাম মুক্তির
সংগ্রাম, এবারের
সংগ্রাম স্বাধীনতার
সংগ্রাম। জয়
বাংলা।’
‘জয় বাংলা’
শব্দটি মুখ ফসকে
অস্ফুট উচ্চারিত হতেই
জিভ কাটে কমল। এই
এক-দেড় মাসে
কথাটি কতবার শোনা
এবং বলা যে
হয়েছে, কমল এই
মুহূর্তে তা
ভাবতে গিয়েও শিউরে
ওঠে। তারপর
মনে পড়ে ২৭মার্চের
কথা। সন্ধ্যার
কিছু পর শহরের
আলীপুর মোড় পেরিয়ে
‘খানের চা’ থেকে
চা কিনে রাস্তায়
নামছিল কমল। দেখলো
কজন মানুষ বারেক
মিয়ার হোটেলের দিকে
ছুটছে। গতকাল
না আজ কোন
এক বেতার কেন্দ্র
থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা
এসেছে। কমল
এগিয়ে যায় কিছুদূর। জটলা
পাকানো কিছু মানুষের
ভীড় ঠেলে কথাবার্তা
শোনার চেষ্টা করে।
একজন বর্ষীয়ান ভদ্রলোক
বলছেন, সোবহানরা গেছিল
পূর্ব খাবাসপুরের মন্টুদের
বাড়ি। ওদের
রেডিওতে নাকি
ধরা পড়েছে ঘোষণাটি। আর
একজন বলছেন, ঘোষনাটি
নাকি কোন এক
সামরিক কর্মকর্তার। অন্য
একজন বলছেন, ‘এ
মুহূর্তে সামরিক
বিভাগের কর্মকর্তার
ডাকে কতটুকু সাড়া
পাওয়া যাবে? একজন
রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্বের
কথাটা শেষ না
হতেই একটি মিছিলের
দিকে সবার দৃষ্টি
ঘুরে জটলা ভেঙে
যায়। মিছিল
এগিয়ে যায় সিনেমা
হলের দিকে। আবার
জটলা বাধে অন্য
একজন লোককে ঘিরে। লোকটি
বলছেন, স্বাধীনতার ঘোষনাটি
বঙ্গবন্ধুর পক্ষে
করা হয়েছে। ছাব্বিশ
তারিখ ভোর রাতেও
শহরে এ রকম
একটি মাইকিং শোনা
গেছে।’
এ কথায় উপস্থিত
লোকজনের মাঝে
স্বস্তির ভাব
ফিরে আসে। কমল
এগিয়ে যায় মিছিলের
দিকে।
এবার মিনির মুখটা
কমলের মনের পর্দায়
ভেসে ওঠে সন্ধ্যাতারার
মতো। প্রতিদিন
অন্তত একবার যাকে
না দেখলে কমলের
জীবনটাই বৃথা
বলে মনে হতো,
সেই মিনিকে কতদিন
যে এভাবে না
দেখে থাকতে হবে
কে জানে?
এ মুহূর্তে এ
ধরনের চিন্তা বহুদিনের
বিস্মৃত ঘটনার
মতোই মনে হয়
কমলের। গত
রাতের ঘটনাও আজ
কেন জানি বহু
পুরোনো, এমনকি আজ
সকাল থেকে যা
যা দেখলো তাও
এ মুহূর্তে অনেক
দিনের ধারাবাহিক ঘটনার মতো
মনের মাঝে উদয়
হতে লাগলো।
এমনই ভাবের ঘোরে
কমলের ক্লান্ত দেহটা
কখন যে নিদ্রার
কোলে ঠাই নিয়েছে
ও জানে না। যখন
ঘুম ভাঙল, তখন
ভোর রাত। ওর
পাশে মা। ঘরের
ভেতর হারিকেনের মৃদু
আলো। উঠোন
থেকে ভেসে আসে
হাম ছাড়ার শব্দ,
সাথে টুকটাক কথার
আওয়াজ। তবে
তা আর আগের
মতো রমরমা নয়।
গাছের ডালে বাদুর
কিচির-মিচির শব্দ
তোলে। শকুন
ডানা ঝাপটায়। ডোবায়
ডাহুক ডাকে। পাতি
শেয়ালের খ্যাক
খ্যাক শব্দ শোনা
যায়। দূরের
কোনো বাড়ি থেকে
কুকুরের লম্বা
লম্বা ডাক ভেসে
আসে। পেঁচা
ডাকে ‘ভূত-ভূত-ভূতুম’,
‘ভূতম-কুক’। পাখি
ডাকে অলক্ষুণে ডাক
‘কুফ্কুফ্...’
কমলের মনে ভয়ের
উদ্ভব হয়। গ্রামের
চেনা রাত এতক্ষণে
ওর মনে ধরা
দেয়। কমলের
জীবনে যদিও ভয়
বলে কিছু নেই,
তবে গ্রামের বাড়ির
গভীর রাতের অবস্থা
আর রাতের সব
মিছিল থেকে ভেসে
আসা ‘হরি বলো-হরি
বলো’ এবং ‘হরি
হরি বলো-হরি
বোল’ শব্দ -এ
দুটোই কমলের উদ্দীপনার
অন্তরায়।
(চলবে)
No comments:
Post a Comment