খুঁজুন

Tuesday, March 21, 2017

কমলের একাত্তর / বাবু ফরিদী (৭)



খুকুদি কমলের চাইতে বয়সে পাঁচ বছরের বড় লোকে বলে কুড়িতে বুড়ি বাপ বাসচালক ভাই বেকার অন্যটি ছোট অর্থ না থাকায় ভালো একটা পাত্র জুটছে না অথচ কী সুন্দর বিদেশীদের মত চেহারা ! ফর্সা রং, চিকন ভ্রু, নাক; টানাটানা চোখ চিনুদির; বোচনেরও একই অবস্থা ঈশান গোপালপুরের জমিদার ঈশান বাবুর জ্ঞাতি ওরা, এক কাপ চা আর একটা টোস্ট এখন যাদের সকালের নাস্তা এবং আভিজাত্যের রেশ!



খুকুদিদের আদিবাস বরিশাল ওদের পূর্বসূরিও জমিদার ছিলেন চেহারা চালচলনে এখনও যার প্রমাণ মেলে অর্থবান আত্মীয়রা সাতচল্লিশের পর চলে গেছেন ওপার বাংলায়, আর এরা পড়ে আছে এখানে ইতিহাসের নির্মম সাক্ষী - দুটো পরিবারের সাথে কমলের পরিবারের বেশী ঘনিষ্ঠতা মামাদের কারণে ওর মামারাও বরিশালের খেলশাকোটার জমিদার ছিলেন গত রায়টে স্টীমারের খোলের মধ্যে করে খালাসীরা তাদের এখানে পৌঁছে দেয় তাঁর সেঝ ভাই উপেনবাবু কমলের দাদুকে তাঁর সাথে এখানেই থাকার পরামর্শ দেন অন্যরা ভারতে চলে গেলেও দাদু তাঁর পরিবারসহ উপেন দাদুর সাথে এখানেই থেকে যান


দাদু হাই স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন আর উপেন দাদু শুরু করেন আইন ব্যবসা অ্যাডভোকেট মজিবর রহমান খান, অ্যাডভোকেট আব্দুল রহমান বাকাউলসহ আরও অনেক আইনজীবী তাঁর হাতেই গড়া দুই দাদুই পরলোকে চলে গেছেন উকিল দাদুর পরিবারও ভারতে এখন আছেন শুধু মামা-মামী-দিদিমা- সমৃদ্ধ পরিবার মামা পরিবার সরিয়েছেন গেল সপ্তাহে এক বন্ধুর বাসায় থেকে তিনি কালেক্টরেট করছেন আজ হয়তো তিনিও শহর ছাড়বেন


এরই মধ্যে কমলের বাবার গোছানোর কাজ শেষ হয়ে যায় মায়ের কাজও শেষ ছোটবোন টাকু উনুন থেকে গরম টি রুটি এনে সবার সামনে রাখে ওরা হাত ধুয়ে গুড় দিয়ে সেগুলো খেয়ে শেষ করে এবার ঘর ছাড়ার পালা


বাবা একটি ট্রাঙ্কের দিকে ইঙ্গিত করে কমলকে বললেন, ওটাতে তোর ক্লাসের বই আছে তোর প্রয়োজনীয় জিনিস ওটাতে ভরে মাথায় নে ভারতীয় লেখকের ইংলিশ মিডিয়ামের বই ওগুলো হাতছাড়া হলে আর মিলবে না


কমল বাবার কথামতো কাজ করলো বাবা টাকু, শুনু কনকের হাতে ছোট-খাটো পোটলি ধরিয়ে দিলেন মাকে দিলেন কাপড়-চোপড়ের গাঁট নিজের জন্য একটি বস্তাসহ চাল-আটার দুটো ব্যাগ বের করে ঘরে তালা ঝুলালেন ঘরের লেপ-তোষক অন্যান্য সামগ্রী দেখিয়ে বললেন, পরেরবার এসে ওসব নিয়ে যাবো, চলো


কমল ঘর ছাড়ল এখন আর কোন সংশয় নেই মনে শুধু পথচলা চলার শেষ যে কোথায়, কেউ তা জানেনা এমন সময় কোথা থেকে দৌঁড়ে এলো ওদের পোষা কুকুর ডলি বারবার ওদের গতি রোধ করতে চাইলো ওরা একটু থেমে আবারও পথচলা শুরু করলো ডলি বিভিন্ন ভঙ্গিমায় ওদের চলে যেতে বারণ করলো কখনও পায়ের উপর পড়ে, কখনও লেজ নুইয়ে আবার কখনও চারদিকে ঘুরে ঘুরে এতে যখন কাজ হলো না, তখন ডলি ওদের পিছু নিলো


দক্ষিণমুখী চলছে কমলের পরিবার ডানে লাহিড়ীবাড়ি বাঁয়ে সান্যাল বাড়ি পেছনে ফেলে পশ্চিমে পথের বাঁক তার ডানে পদা শীল বাঁয়ে সচীন সাহার বাড়ি পেড়িয়ে নিত্য শীল মজিদ মোল্যার বাড়ি ছাড়তেই বিহারি কলোনি


কলোনির রাস্তায় পা রাখতেই কমলের গা ছমছম করে বুকের ভেতর থেকে একটা শূন্যতা গলা পর্যন্ত উঠে আঁটকে যায় কিছুটা পথ এগুতেই পুকুরপাড়ে আট-দশজনের একটি যুবক দল ওদের গতিরোধ করে তাদের হাতে ছোঁরা, চাকু ড্যাগার কমলদের উদ্দেশ্যে ওরা বিহারি ভাষায় অনেক গালমন্দ করতে থাকে


এমন সময় কোথা থেকে ছুটে এলো আর একজন বিহারি ছেলে কমলের বয়েসী কমল ওকে চেনে নাম হোকল ওর বাবা কমলদের চুল কাটে, খৌরকর্ম করে ছেলেটি যুবকদের হাত থেকে কমলদের পরিবার রক্ষা করার চেষ্টা করে নানাভাবে ওদের বুঝাতে চেষ্টা করে- ওরা আমাদের খুব আপন লোক ওদের কোন ক্ষতি তোরা করতে পারবি না


এতে যুবকদল চটে যায় এক সময় তা হাতাহাতিতে রূপ নিলে, মুরুব্বি ধরনের কিছু বিহারি সেখানে এসে ঘটনার যবনিকা ঘটায় তারা বাবাকে ডাক্তারবাবু বলে সম্বোধন করে বললেন, কোন ভয় নাই, আপনি সোজা পথে চক বরাবর চলে যান


ওরা তাই করলো পেছনে ডলি কলোনির টি কুকুরের পাল্লায় পড়ে পিছিয়ে রইল কলোনি পেড়িয়ে রাস্তা রাস্তার ডানে এনায়েত সাহেবের বাড়ি, মোহন মল্লিকের বাড়ি পেছনে ফেলে কিছুটা এগুলে রাস্তা গিয়ে ঠেকেছে দরবেশের জলায় জলার পাড় দিয়ে হালট, হালট ধরে আলতাফ মিয়ার বাড়ির ডান দিক দিয়ে দুতিনটি বাড়ি, পরে ফাঁকা মাঠ হালটের উপর দিয়ে কমলরা হাঁটতে থাকে তুলা গ্রামের উদ্দেশ্যে  

দুমাইল পাড়ি দিলেই গ্রাম ধান পাটের ছোট ছোট চারায় আচ্ছাদিত সবুজ মাঠ কার্পেটের মত শোভা পাচ্ছে মাঠে কৃষক আগাছা নিড়ানোর কাজে ব্যস্ত তাদের কেউ কেউ ওদের গন্তব্যের কথা জানতে চায় আরও খানিকটা পথ পেরুলে শহর থেকে বিচ্ছিন্ন কৃষকগণ শহরের পরিস্থিতি এবং খানসেনাদের অবস্থান সম্বন্ধে জানতে আগ্রহী হয় ওরা যতদূর জানে ততটুকু জানায় এভাবেই শেষ হয় চক পাড়ি দেয়ার সময়গুলো


এক সময় ওরা তুলাগ্রামের আবাসিক এলাকায় ঢুকে পড়ে কমলের মা ওর বাবাকে প্রশ্ন করেন, আচ্ছা, আজ এপ্রিল মাসের একুশ তারিখ না?


হ্যাঁ বাবা সংক্ষিপ্ত জবাব দেন


মা আবারও মুখ খোলেন- আজ তো বুধবার কমলের জন্মদিন!

      কমলের বাবা আর কোন কথা বললেনা

 

(চলবে) 

No comments:

Post a Comment