খুকুদি কমলের চাইতে
বয়সে পাঁচ বছরের
বড় ।
লোকে বলে কুড়িতে
বুড়ি ।
বাপ বাসচালক । ভাই
বেকার ।
অন্যটি ছোট । অর্থ
না থাকায় ভালো
একটা পাত্র জুটছে
না ।
অথচ কী সুন্দর
বিদেশীদের মত
চেহারা ! ফর্সা রং,
চিকন ভ্রু, নাক;
টানাটানা চোখ
চিনুদির; বোচনেরও
ঐ একই অবস্থা
। ঈশান
গোপালপুরের জমিদার
ঈশান বাবুর জ্ঞাতি
ওরা,
এক কাপ চা
আর একটা টোস্ট
এখন যাদের সকালের
নাস্তা এবং আভিজাত্যের
রেশ!
খুকুদিদের আদিবাস
বরিশাল ।
ওদের পূর্বসূরিও জমিদার
ছিলেন ।
চেহারা চালচলনে এখনও
যার প্রমাণ মেলে । অর্থবান
আত্মীয়রা সাতচল্লিশের
পর চলে গেছেন
ওপার বাংলায়, আর
এরা পড়ে আছে
এখানে ।
ইতিহাসের নির্মম
সাক্ষী -এ দুটো
পরিবারের সাথে
কমলের পরিবারের বেশী
ঘনিষ্ঠতা মামাদের
কারণে ।
ওর মামারাও বরিশালের
খেলশাকোটার জমিদার
ছিলেন ।
গত রায়টে স্টীমারের
খোলের মধ্যে করে
খালাসীরা তাদের
এখানে পৌঁছে দেয়
। তাঁর
সেঝ ভাই উপেনবাবু
কমলের দাদুকে তাঁর
সাথে এখানেই থাকার
পরামর্শ দেন
। অন্যরা
ভারতে চলে গেলেও
দাদু তাঁর পরিবারসহ
উপেন দাদুর সাথে
এখানেই থেকে যান
।
দাদু হাই স্কুলে
শিক্ষকতা শুরু
করেন আর উপেন
দাদু শুরু করেন
আইন ব্যবসা । অ্যাডভোকেট
মজিবর রহমান খান,
অ্যাডভোকেট আব্দুল
রহমান বাকাউলসহ আরও
অনেক আইনজীবী তাঁর
হাতেই গড়া । দুই
দাদুই পরলোকে চলে
গেছেন ।
উকিল দাদুর পরিবারও
ভারতে ।
এখন আছেন শুধু
মামা-মামী-দিদিমা-
সমৃদ্ধ পরিবার । মামা
পরিবার সরিয়েছেন গেল
সপ্তাহে ।
এক বন্ধুর বাসায়
থেকে তিনি কালেক্টরেট
করছেন ।
আজ হয়তো তিনিও
শহর ছাড়বেন ।
এরই মধ্যে কমলের
বাবার গোছানোর কাজ
শেষ হয়ে যায়
। মায়ের
কাজও শেষ । ছোটবোন
টাকু উনুন থেকে
গরম ক’টি রুটি
এনে সবার সামনে
রাখে ।
ওরা হাত ধুয়ে
গুড় দিয়ে সেগুলো
খেয়ে শেষ করে
। এবার
ঘর ছাড়ার পালা
।
বাবা একটি ট্রাঙ্কের
দিকে ইঙ্গিত করে
কমলকে বললেন, ‘ওটাতে
তোর ক্লাসের বই
আছে ।
তোর প্রয়োজনীয় জিনিস
ওটাতে ভরে মাথায়
নে ।
ভারতীয় লেখকের ইংলিশ
মিডিয়ামের বই
। ওগুলো
হাতছাড়া হলে
আর মিলবে না’ ।
কমল বাবার কথামতো
কাজ করলো । বাবা
টাকু, শুনু ও
কনকের হাতে ছোট-খাটো
পোটলি ধরিয়ে দিলেন
। মাকে
দিলেন কাপড়-চোপড়ের
গাঁট ।
নিজের জন্য একটি
বস্তাসহ চাল-আটার
দুটো ব্যাগ বের
করে ঘরে তালা
ঝুলালেন ।
ঘরের লেপ-তোষক
ও অন্যান্য সামগ্রী
দেখিয়ে বললেন, ‘পরেরবার
এসে ওসব নিয়ে
যাবো, চলো’ ।
কমল ঘর ছাড়ল
। এখন
আর কোন সংশয়
নেই মনে । শুধু
পথচলা ।
এ চলার শেষ
যে কোথায়, কেউ
তা জানেনা । এমন
সময় কোথা থেকে
দৌঁড়ে এলো ওদের
পোষা কুকুর ডলি
। বারবার
ওদের গতি রোধ
করতে চাইলো । ওরা
একটু থেমে আবারও
পথচলা শুরু করলো
। ডলি
বিভিন্ন ভঙ্গিমায়
ওদের চলে যেতে
বারণ করলো । কখনও
পায়ের উপর পড়ে,
কখনও লেজ নুইয়ে
আবার কখনও চারদিকে
ঘুরে ঘুরে । এতে
যখন কাজ হলো না,
তখন ডলি ওদের
পিছু নিলো ।
দক্ষিণমুখী চলছে
কমলের পরিবার । ডানে
লাহিড়ীবাড়ি বাঁয়ে
সান্যাল বাড়ি
পেছনে ফেলে পশ্চিমে
পথের বাঁক । তার
ডানে পদা শীল
বাঁয়ে সচীন সাহার
বাড়ি পেড়িয়ে নিত্য
শীল ও মজিদ
মোল্যার বাড়ি
ছাড়তেই বিহারি কলোনি
।
কলোনির রাস্তায় পা
রাখতেই কমলের গা
ছমছম করে । বুকের
ভেতর থেকে একটা
শূন্যতা গলা
পর্যন্ত উঠে
আঁটকে যায় । কিছুটা
পথ এগুতেই পুকুরপাড়ে
আট-দশজনের একটি
যুবক দল ওদের
গতিরোধ করে । তাদের
হাতে ছোঁরা, চাকু
ও ড্যাগার । কমলদের
উদ্দেশ্যে ওরা
বিহারি ভাষায় অনেক
গালমন্দ করতে
থাকে ।
এমন সময় কোথা
থেকে ছুটে এলো
আর একজন বিহারি
ছেলে ।
কমলের বয়েসী । কমল
ওকে চেনে । নাম
হোকল ।
ওর বাবা কমলদের
চুল কাটে, খৌরকর্ম
করে ।
ছেলেটি যুবকদের হাত
থেকে কমলদের পরিবার
রক্ষা করার চেষ্টা
করে ।
নানাভাবে ওদের
বুঝাতে চেষ্টা করে-
‘ওরা
আমাদের খুব আপন
লোক ।
ওদের কোন ক্ষতি
তোরা করতে পারবি না’ ।
এতে যুবকদল চটে
যায় ।
এক সময় তা
হাতাহাতিতে রূপ
নিলে, মুরুব্বি ধরনের
কিছু বিহারি সেখানে
এসে ঘটনার যবনিকা
ঘটায় ।
তারা বাবাকে ডাক্তারবাবু
বলে সম্বোধন করে
বললেন, ‘কোন ভয়
নাই, আপনি সোজা
পথে চক বরাবর
চলে যান’ ।
ওরা তাই করলো
। পেছনে
ডলি কলোনির ক’টি
কুকুরের পাল্লায়
পড়ে পিছিয়ে রইল
। কলোনি
পেড়িয়ে রাস্তা । রাস্তার
ডানে এনায়েত সাহেবের
বাড়ি, মোহন মল্লিকের
বাড়ি পেছনে ফেলে
কিছুটা এগুলে রাস্তা
গিয়ে ঠেকেছে দরবেশের
জলায় ।
জলার পাড় দিয়ে
হালট, হালট ধরে
আলতাফ মিয়ার বাড়ির
ডান দিক দিয়ে
দু’তিনটি
বাড়ি, পরে ফাঁকা
মাঠ ।
হালটের উপর দিয়ে
কমলরা হাঁটতে থাকে
তুলা গ্রামের উদ্দেশ্যে
।
দু’মাইল
পাড়ি দিলেই গ্রাম
। ধান
পাটের ছোট ছোট
চারায় আচ্ছাদিত । সবুজ
মাঠ কার্পেটের মত
শোভা পাচ্ছে । মাঠে
কৃষক আগাছা নিড়ানোর
কাজে ব্যস্ত । তাদের
কেউ কেউ ওদের
গন্তব্যের কথা
জানতে চায় । আরও
খানিকটা পথ
পেরুলে শহর থেকে
বিচ্ছিন্ন কৃষকগণ
শহরের পরিস্থিতি এবং
খানসেনাদের অবস্থান
সম্বন্ধে জানতে
আগ্রহী হয় । ওরা
যতদূর জানে ততটুকু
জানায় ।
এভাবেই শেষ হয়
চক পাড়ি দেয়ার
সময়গুলো ।
এক সময় ওরা
তুলাগ্রামের আবাসিক
এলাকায় ঢুকে পড়ে
। কমলের
মা ওর বাবাকে
প্রশ্ন করেন, ‘আচ্ছা,
আজ এপ্রিল মাসের
একুশ তারিখ না?’
‘হ্যাঁ’ –বাবা
সংক্ষিপ্ত জবাব
দেন ।
মা আবারও মুখ
খোলেন- ‘আজ তো বুধবার
। কমলের
জন্মদিন!’
No comments:
Post a Comment