কমলের একাত্তর / বাবু ফরিদী (৬)
মিনতি নিষ্ক্রান্ত হলে,
কমল ওদের বাড়ির
দিকে এগোয় । ঘরে ঢুকেই দেখতে পায় মা পোটলা-পাটলী
বাঁধার কাজে ব্যস্ত
, আর বাবা টিনশেড
ওয়ালদেয়া ঘরের
একটি কক্ষে মাটির
মেঝ প্রায় পাঁচ
ফুট খুঁড়ে তার
ভেতর দাঁড়িয়ে । তিনি
নিচ থেকে মাটি
কেটে উপরে তুলছেন
একটি গামলায় করে
। কমল
ওদিকে এগোয় । ওকে
দেখে বাবা বললেন,
‘যাহ্
, কাঁসা-পিতলের বাসন-কোষন
যা আছে নিয়ে
আয়’
।
কমল ট্রাঙ্ক খুলে
এক এক করে
বাসন-কোষন আনছে,
আর ওর বাবা
সেগুলো গর্তের ভেতর
ভরে ভরে সাজিয়ে
রাখছেন...
এই মুহূর্তে কমলের
মনে শোকের ছায়া
নেমে আসে । ওর
মনের পর্দায় ভেসে
ওঠে বন্ধুদের মুখচ্ছবি
– খুকুদি, সন্ধ্যা, নারায়ণ,
গোপাল । শ্রীঅঙ্গনের বিষ্ণু, জলার
(স্থানীয় জলাশয়)
ওপাড়ের চিনুদি,
বোচন, মধু । ওয়ারলেস
পাড়ার লন্টু ভাই,
ওদের ভাড়াটিয়ার ছেলে
বঙ্কু, তার বোন
শান্তদি...
শান্তদির কথা
মনে হতেই চোখ
দুটো ঝাপসা হয়ে
আসে কমলের ।
আহা, কমলের এস,এস,সি,
পরীক্ষার আগে
কত দিন অনেক
রাত অবধি জেগে
থেকেছে ওর সাথে
শান্তদি! ও
একা একা পড়তে
ভয় পেত । মা
ছ’-সাতজন সন্তান
নিয়ে দিনভর সংসারের
ঘানি টেনে কমলকে
সঙ্গ দিতে পারেনি
। তাঁর
পরিশ্রান্ত দেহটা
বিছানার স্পর্শেই
অচেতন হয়ে পরেছে
। শান্তদিকে
বলেছে, ‘শান্ত, ওর
সাথে একটু কষ্ট
করো মা । সামনে
ওর পরীক্ষা, রাত
জেগে না পড়লে
পাস করবে কি
করে ?’
শান্ত তাই করেছে
। বাতাস
করে, মাথায় হাত
বুলিয়ে ঘাঁমাচি খুটে
দিয়ে কমলের পড়ার
টেবিলে সঙ্গ দিয়েছে
।
সেই শান্তদির বিয়ে
হয়েছে ফাল্গুন মাসের
শেষে ।
আজ বৈশাখের প্রথম
সপ্তাহ ।
শান্তদির জন্য
একটা ভ্যানিটি ব্যাগ
কেনা হয়েছিল । ওটা
আর তাকে দেয়া
হয়নি ।
আশা ছিল মেলানী
ভেঙ্গে সময় করে
এখানে এলে দিয়ে
দেয়া যাবে । শান্তদি
আর আসেনি । পঁচিশে
মার্চের পর
দেশ তো প্রায়
অচল ।
শান্তদির বাবা
গরিব ।
ও বঙ্কুদের বাড়িতে
থাকতো ।
বঙ্কু ওর মামাতো
ভাই ।
শান্তদির বিয়ে
হয়েছে এক আধবুড়ো
লোকের সাথে । অথচ
শান্তদির কি
কচি বয়স! সময়ে
সময়ে যখন স্নান
করে কমলের সামনে
এসে চুল মুছতো,
ঝাড়তো আর পড়ার
জন্য তাড়া দিতো। তখন ও
দেখেছে শান্তদি কত
সুন্দর ! যেমন রূপ,
তেমন গুণ । ওর
যদি তপনদা, শ্যামা
– ওদের কারো সাথে
বিয়ে হতো, তাহলে
মানাতো বেশ । কিন্তু
তা হয়নি । এ
জন্যেই শান্তদির জন্য
কষ্ট হয় কমলের
। আর
বিয়ের পর শ্বশুর
বাড়ি যাবার সময়
কমলকে বুকে জড়িয়ে
কী কান্নাটাই না
কেঁদেছিল শান্তদি
! কমলও কেঁদেছিল । তবে
বেশী কেঁদেছিল শান্তদির
বিয়ে হয়ে যাওয়ার
পর ।
বিষয়টি বঙ্কু কাকার
চোখে হয়তো ভালো
ঠেকেনি ।
কারণ, সে রকমই
একটা দৃষ্টি বঙ্কু
কাকা ওর প্রতি
পোষণ করছিল সে
মুহূর্তে ।
সেটাই স্বাভাবিক । সকলেই
যখন লৌকিকতাবশত দু’-এক
ফোটা চোখের জল
ছেড়ে মেয়ে পার
করতে পেরে বেঁচে
গেছে, তখন অনাত্মীয়ের
ছেলে এভাবে কেঁদে
কেঁদে হেঁচকি উঠাবে,
এমন তো হবার
কথা নয়!
কমল তা টের
পেলো তখন, যে মুহূর্তে কান্নার
বাধ রক্ষা করা
ওর পক্ষে অসম্ভব
হয়ে পড়েছিলো। কমলের
দুঃখটা ওখানেই, যে
শান্তদিকে শেষ
পর্যন্ত একজন
মাঝবয়েসী স্বামীর
সাথে ঘর করতে
হবে !
বঙ্কুরা ওদের
বাসা ছেড়েছে এ
মাসেই ।
ওদের নীলটুলীর বাড়ি
নিয়ে মামলা চলছিলো
, তাই এক বছর
যাবৎ কমলদের বাসায়
ভাড়া থাকতো । কিন্তু
গোলমালের কারণে
আগে থেকেই দেশের
বাড়ি নতুবদিয়ায় পরিবার-পরিজন
নিয়ে সরেছে ।
হঠাৎ পেছনে কারো
কণ্ঠে সম্বিত ফিরে
পায় কমল ।
‘কিরে
ডাকতে ডাকতে তোদের
বাড়িতে ঢুকলাম, আর
তুই শুনলি নে
?’
চোখ
ফেরাতেই ভুত
দেখার মতো চমকে
ওঠে কমল, ‘আরে
খুকুদি ? সন্ধ্যা ? আপনারা
? এখনও যাননি ?’
‘তোদের
সাথে দেখা করতে
এলাম’
।
‘আমি
আরও ভেবেছি আপনারা
এতক্ষণে সরে
পড়েছেন’।
‘আমাদের
তো সরে পড়ার
জায়গা নেই রে,
তাই ভেবেছিলাম কোথাও
যাবনা ।
কিন্তু পাড়ার কেউই
যখন থাকছে না,
তখন শ্মশানের মতো
পরের বাড়ি আগলে
থেকে বিপদ বাড়বে
বৈ কমবে না
। অজিত
কাকুরা চলে গেছেন;
যাবার আগে বলে
গেছেন, এখানে থাকতে
না পারলে ওনার
শ্বশুর বাড়ি বাগাট
যেতে ।
তাদের ঘরের চাবি
দিয়ে গেছেন, কিন্তু
এখন যা পরিস্থিতি,
আর থাকা যায়
না ।
আমরা ডাগর তিনটি
বোন, মা-বাপী
বুড়ো, ভাই দুটো যুবক
। বিহারিরা
যেভাবে ঘুরছে, কখন
যে কী ঘটবে
!’...
কথার মাঝে কমলের মা
এসে দাঁড়ায় ।
খুকুদির কথা
শেষ না হতেই
কমলের বাবা বললেন,
‘তোমাদের
সরে পড়াই উচিত’ ।
‘হ্যাঁ,
বাপীর মধুখালির ট্রিপ
খানিক পরে । আপাতত
বাগাতেই যাবো
। তারপর
পরিস্থিতি খারাপের
দিকে মোড় নিলে
সোজা ইন্ডিয়া চলে
যাবো ।
আর ফিরবো না
। এ
দেশে তো আমাদের
কেউ নেই । এছাড়া
নিজস্ব বলতেও কোন
কিছুই নেই’ ।
‘আপনারা
একেবারেই চলে
যাবেন ? আর কখনও
আসবেন না ?’ – কমলের
মুখ থেকে বুকের
কষ্টে ভিজে কথাগুলো
বেরোয় ।
‘হ্যাঁ,
ভাই ।
একেবারেই চলে
যাবো ।
আর আসব না’ – খুকুদি
কান্নাজড়িত কণ্ঠে
কথাগুলো বলতে
বলতে কমলের মাথাটা
বুকের মধ্যে নিয়ে
আদর করে । তারপর
অস্ফুট কান্না বুকে
চেপে ঠোঁট কামড়ে
কষ্টগুলো সংবরণ
করতে করতে কমলের
মাথাটা মুক্ত করে
চলে যায় ।
‘আসিরে
কমল’
– বলে সন্ধ্যা ওর
পিছু নেয় ।
(চলবে)
No comments:
Post a Comment