হঠাৎ
কমলের বাবার মুখ
ফসকে যায় – ‘কী
যে হবে !’
কমল
বাবার মুখের দিকে
তাকায় ।
বাবাও তাকায় ওর
মুখে ।
বলে , ‘এখন আর
সময় নষ্ট করা
ঠিক না । চল,
আমরাও শহর ছাড়ার
জন্য প্রস্তুত হই
গে’
।
বাবার
সাথে বাড়ি ফিরে
আসে কমল । আসার
পথে প্রতিবেশী প্রায়
বাড়িতেই মালপত্র
বাঁধা-সাধা, লুকানোর
কাজ দেখতে পায়
।
সমাদ্দার
বাবুর বাঁধা-সাধার
কাজ শেষ । নিজেরাই
হাতে-সাথে করে
গন্তব্যের উদ্দেশ্যে
ছুটবে অল্প কিছুক্ষণের
ভেতর ।
বাবাকে দেখেই তিনি
এগিয়ে এলেন । উৎকণ্ঠার সাথে
বললেন, ‘আপনি কেমন
মানুষ বলেন তো
? এখনও কি ভাববার
সময় আছে ? ঝটপট
মালপত্র বেঁধে
ফেলুন ।
আর ঐ যে--'
সমাদ্দার
বাবু একটু চাপা
গলায় বাবার কানের
কাছে মুখ নিয়ে
বললেন, ‘সোনা-রুপা,
কাঁসা-পিতল যা
আছে, তা ঘরের
মেঝে খুঁড়ে পুঁতে
ফেলুন--- জীবনে
বেঁচে থাকলে ফিরে
এসে তুলবেন’ ।
‘ঠিক কথাই
বলেছেন ।
এত মালপত্র টেনে
নেয়াও তো মুশকিল’ ।
সমাদ্দার
বাবুর কাছ থেকে
আরও একটি সৎপরামর্শ
পেয়ে কিছুটা হালকা
হলেন কমলের বাবা
। তারপর
লেপ-তোষক, বইপত্র,
চাল-আটাসহ প্রয়োজনীয়
জিনিসপত্রের কিছু
কিছু বস্তাবন্দী, বাক্সবন্দী
করতে থাকলেন । কমল,
ওর মাসহ পরিবারের
অন্যান্য ভাইবোন
যে যেভাবে পারে
বাবাকে সাহায্য করলো
।
কিছুক্ষণের
মধ্যেই মাথায় একটি
বড় বস্তাসহ সমাদ্দার
বাবু পুনরায় কমলদের
বাড়িতে এলেন । ওর
বাবাকে ডাকলেন ।
বাবা
তাকে দেখে ঘর
থেকে বেরুলেন । বললেন,
‘যাচ্ছেন
?’
‘হ্যাঁ দাদা,
জীবনে যদি বেঁচে
থাকি একদিন হয়ত
দেখা হবে । আর
যদি মরে যাই,
কোন কিছুতে দাবি
রাইখেন না দাদা
। ভুল-ত্রুটি
ক্ষমা করে দেবেন’
--- সমাদ্দার বাবু
ডুকরে কেঁদে উঠলেন
।
বাবা
তাঁর পিঠে হাত
বুলিয়ে, অন্য হাতের
তালুতে নিজের চোখ
মুছলেন ।
সমাদ্দার
বাবু বাড়ি ছাড়লেন
। পেছনে
তাঁর স্ত্রী । মার
সাথে তাঁরও বিদায়
নেবার পালা শেষ
হলো ।
আরও পেছনে বাবুল,
বুলি, বাবন...
হঠাৎ
করেই বাবার মাথায়
যেন বাজ পড়লো
। তাড়াতাড়ি
কমলকে ডেকে দোকানের
চাবি দিয়ে বললেন,
‘তুই
শীঘ্রই বাজারে যা
। দোকানে
গিয়ে জয় বাংলার
পতাকাটা নামিয়ে
পাকিস্তানি পতাকাটা
টাঙিয়ে আয় তাড়াতাড়ি’।
বাবার
কথা শেষ হতেই
কমলের কান দিয়ে
গরম বাতাস বেরুনো
একটা থ্রিল কাজ
করলো ।
ও দৌড়ে বাজারের
উদ্দেশ্যে ঘর
ছাড়লো ।
কমল
যখন যশোহর রোডে
পা রাখল, তখন
ওর বুকের ভেতর
একটা অজানা আশংকা
মোচড় খেল । শতশত
পরিবার ভাটির টানের
মত পশ্চিমে যাচ্ছে, কেউবা
দক্ষিণে, আর
কমল ওদের উজানে
।
শহরবাসীর
বিপরীতমুখী টান
ওকে আর একবার
শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থার
মধ্যে ফেলে দিলো
। দু’-একজন
হিতাকাঙ্খী ওকে
শহরের ভেতর ঢুকতে
বারণ করলো ।
কমল
কারো কথায় কর্ণপাত
করলো না ।
বাবার নির্দেশের চাইতেও
ওর এখন নতুন
অভিজ্ঞতার মুখোমুখি
হতে ভালো লাগে
। ভাটির
স্রোতে ভাসা মানুষগুলো
বিলি কেটে কেটে
ও যখন ওদের
দোকানের কাছাকাছি
পৌঁছল, তখন দেখলো
আলীমুজ্জামান সেতুর
গোঁড়ায় ক’টি
মাড়োয়ারি পরিবার
নৌকার অপেক্ষায় বসে
আছে ।
কমল ওদের পরিবারের সকলকে
দলবেঁধে এই
প্রথম দেখল । তাদের
পায়ে হাঁটার সামর্থ
নেই, রিক্সারও এই
মুহূর্তে দারুণ
অভাব ।
তাই বাধ্য হয়েই
নৌকার কথা তাদের
মাথায় ঢুকেছে ।
শিবমন্দির সংলগ্ন
ঘাটে অন্যদিন মাল
ওঠানো-নামানোর কাজে
যেসব নৌকা দেখা
যেত সেগুলোর টিকিটি
পর্যন্ত আজ
দেখা যাচ্ছে না
। লোকজন
বলাবলি করছে, নৌকাওয়ালারা
আজ শহরে আসছে
না ।
ঘাটে যে ক’টা
রাতে বাঁধা ছিল,
সেগুলো ভোরে গ্রামমুখী
মানুষ নিয়ে ভেগেছে
। নৌকার
মাঝিদের ভয়য়,
নৌকা হোল শেখ
মুজিবের মার্কা;
খানসেনাদের আক্রোশ
হয়তো ওটার ওপরই
থাকবে বেশী ।
(চলবে)
No comments:
Post a Comment