কমল বাবাকে সান্ত্বনা দেয়, ‘না, বাবা । মিলিটারি শহরে ঢোকেনি । ঢুকলেও হয়ত আমাদের এলাকায় কোন ক্ষতি করবে না । যেখানে ওদের ভয় এবং বাধা সেখানেই ওরা আগুন ধরাবে, ক্ষতি করবে, গুলি চালাবে । শহরে তো ওদের রুখবার কেউ নেই । নির্বিঘ্নে শহরে ঢুকতে পারলে দেখবে কাল থেকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে’।
‘তুই
জয় বাংলার পতাকা
নামিয়েছিলি তো?’
‘হ্যাঁ’
‘পাকিস্তানি
পতাকা?’
‘তুলেছি’
‘যাক,
দোকানের সিন্দুকে
শুকুর ডাক্তারের সর্বস্ব
। সেগুলো
রক্ষা হলেও...’
বাবার কথা শেষ
না হতেই পরিচিত
একজন বাবার সামনে
আসে- ‘ডাক্তারবাবু, কোথায়
উঠেছেন?’
‘তুলাগ্রাম
। ভোলাদা’র
ওখানে’ ।
লোকটির সাথে কথা
বলতে বলতে বাবার
চতুর্দিকে আরও
কিছু পরিচিত মানুষ
আসে ।
এরই ফাঁকে কমল
ক’পা এগিয়ে
যায় ।
বাবার দৃষ্টি এড়ায়
না ।
বাবা বলেন, ‘কোথায়
যাস? আমরা চল
ফিরে যাই । ভাব
বুঝে কাল আসা
যাবে’ ।
‘আমি
একটু সামনে থেকে
আসি বাবা, ওখানে
আমার ক’জন
পরিচিত বন্ধুবান্ধব আছে’। -- কমল হাঁটতে
হাঁটতে বলে ।
‘না,
তোর ওদিকে যাবার
দরকার নেই । আমি
এক্ষুনি ফিরবো’
।
‘আমার
দেরী হলে তুমি
ফিরে যেও বাবা
। আমি
ওদের সাথে ফিরবো’
।
‘না,
তুই এদিকে আয়’
।
‘এইতো
আসছি’ ।
--
কমল সামনের মানুষগুলোর
ভিড়ে হারিয়ে যায়
।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে
আসে ।
কমল এক পা-দু’পা
করে এগোয় । একগুচ্ছ
মানুষ পেছনে ফেলে
আর একগুচ্ছের সাথে
এগোয় ।
এভাবে জলার আগারীতে
এসে পৌঁছে । সামনেই
ওদের গ্রাম ।
এরই মধ্যে ক’রাউন্ড
গুলির শব্দ শোনা
যায় ।
কমল থমকে দাঁড়ায়
। ভোঁস-ভোঁস
শব্দে কয়েকটি লরি
(ট্রাক) আঙ্গিনা বরাবর
শহরের দিকে ছোটার
শব্দ ভেসে আসে
। কিছুক্ষণ
পরে আরও কিছু
ট্রাকের গর্জন
শোনা গেল । এবার
শহরের দিকে আগুনের
লেলিহান শিখা
নজরে এলো । সাথে
গুলির শব্দ । ছড়-ছড়
শব্দে গাছপালা ভেদ
করে চলছে বুলেট...
কতক্ষণ এভাবে কেটে
গেছে, কমলের হিসেব
নেই ।
সম্বিত যখন ফিরল,তখন
ও দেখল অল্প
অল্প করে মানুষ
গ্রামের মধ্যে
নিজেদের ভিটা-বাড়ির
দিকে ফিরছে ।
কমল দ্রুত পা
চালায় ওদের বাসার
উদ্দেশ্যে । শ্রীঅঙ্গনের দক্ষিণ
দিক দিয়ে দ্রুত
হেঁটে টইন্টা শীলের
ঝোড়ের ভেতর ঢুকে
পড়ে ও । কিছুটা
পথ অতিক্রম করে
সোজা হারু দত্তের
বাড়ি বরাবর শ্রীঅঙ্গনের
বাগানবাড়ির ভেতরের
নির্জন একপায়া পথ
দিয়ে ওদের বাড়ি
সোজা গিয়ে দাঁড়ায়
। তারপর
দুই হাতে তারকাটার
বেড়া ফাঁক করে
ওদের বাড়ির চত্বরে
পা রাখতেই ‘ঘেউ-ঘেউ’
রবে ডলি চিৎকার
শুরু করলো ।
কমল অস্ফুট স্বরে
বলল, ‘ডলি, থাম!
আমি!’
কিন্তু কাজ হলনা
। দলির
ঘেউ-ঘেউ শব্দ
আরও জোরে জোরে
আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত
করে চলল ।
ও এবার ধমকের
সুরে বলল, ‘আহ!
ডলি, থাম!’
ডলি ক’পা
পিছিয়ে গিয়ে কুন্দি-ফান্দি
করতে লাগলো ‘ঘেউ-ঘেউ’
রবে ।
সহসা একটি তিন
ব্যাটারির টর্চের
আলো এসে আছরে
পড়লো ওদের বাড়ির
দেয়ালে ।
কমল দ্রুত ছুট
দেয় সেখান থেকে
। তারকাটার
বেড়া ডেঙ্গিয়ে ও
রুদ্ধশ্বাসে চক
বরাবর দৌড়ায় ।
আস্তানায় যখন
ফিরল কমল, তখন
দেখল উঠোনভর্তি লোক
। বাবা
উদ্বিগ্ন চিত্তে
পায়চারি করছেন
। মা
কাঁদছেন ।
কমলের নিজেকে বড়
অপরাধী মনে হল
। কেন
যে ওদিকে গেল
আর কিভাবে যে
এতটা পথ ফিরে
এলো, এখন তা
কিছুই মনে করতে
পারল না । শুধু
একটা দুঃখ মনের
ভেতর মোচর খেল
যে, এতদিনের পরিচিত
ডলি এই কয়েক
ঘণ্টার ব্যবধানে ওকে
চিনতে পারল না!
আর একটু হলেই
যে কী ঘটে
যেত! অল্পের জন্য
রক্ষা ।
বাবা ওকে দেখেই
ছুটে এলেন কাছে
। চিৎকার
করে জিজ্ঞেস করলেন,
‘কোথায়
গেছিলি?’
‘বাসায়’
No comments:
Post a Comment