কখন
যে দোকানের সামনে
এসে দাঁড়িয়েছে, তা
টের পায়নি কমল । দোকানের
সামনে বড় একটি
সাইনবোর্ড –‘কোহিনূর
ফার্মেসী’ । তার
উপরে টিনের চাল
থেকে প্রায় ছ’ফুট
উপরে পতপত করে
উড়ছে তল্লা বাঁশের
সাথে বাধা স্বাধীন
বাংলার লাল-সবুজ পাতাকা
। স্বাধীনতা
ঘোষণার পর থেকে
এটা চল্লিশ ঘণ্টা
ধরে আকাশে উড়ছে
।
আশেপাশের
দোকানগুলোতে চোখ
বুলায় কমল । দেখে
জয় বাংলার পতাকার
স্থলে এখন উড়ছে
চাঁদ-তারা খচিত
পাকিস্তানি পতাকা!
দু’-একটি দোকানে
কোনো পতাকাই নেই
।
কমল
দোকান খুলে পাকিস্তানি
পতাকাটা খুঁজে
বের করে । তারপর
দরজায় তালা ঝুলিয়ে
স্ট্যান্ডের সামনে
দাঁড়ায় ।
জয় বাংলার পতাকা
নামাবার উদ্দেশ্যে
হাত রাখে স্ট্যান্ডে
। পতাকার
দিকে তাকিয়ে থাকে
কিছুক্ষণ ।
মনের অজান্তেই ওর
দু’চোখ উপচে
জল আসে...
হঠাৎ
পেছন থেকে কে
একজন ধমকের সুরে
বলে ওঠে, ‘শালা
মালাউন ! নামা ওটা!’
কমল দেখলো
ওর পেছনে একজন
রিকশাওয়ালা । কিন্তু তার
সাথে এখন কোন
রিক্সা নেই ।
মনে কলো লোকটা
হয়তো রিফিউজি হবে,
তবে ওদের এলাকার
কেউ নয় । লোকটার
কোমরে একটি ড্যাগার
লক্ষ্য করলো কমল
। তারপর
আস্তে আস্তে জয়
বাংলার পতাকাটা স্ট্যান্ড
থেকে খুলে ভাঁজ
করে কোমরে গুজতে
যাচ্ছিল ও,
অমনি বাঁজপাখির মতো
পতাকাটি ছোঁ
মেরে নিয়ে নিল
লোকটি ।
মুখে বললো, ‘শালা,
হারামীর বাচ্চা,
মরবার স্বাদ হইছে
?’ তারপর
ওটা ছুঁড়ে ফেলে
দিল নর্দমায় । ভয়ে
সমস্ত শরীর গেঁথে
গেল কমলের । দুরু
দুরু বুকে বাড়ির
দিকে পা বাড়ালো
ও । কিন্তু সামনে
এসে দাঁড়ালো লোকটি
। রক্ত-চোখে
ওর কাঁধের দিকে ইঙ্গিত
করলো ।
সম্বিত ফিরে পেলো
কমল ।
মনে পড়লো
কাঁধে ঝুলানো পাকিস্তানি পতাকার
কথা ।
ভয়ে ভয়ে ওটি
উড়ালো আকাশে ।
লোকটি
এরপর পথ ছাড়ে
। কমল
এগোয় বাড়ির উদ্দেশ্যে
। হঠাৎ
ওর মনের পর্দায়
ভেসে ওঠে মিনতির
মুখ ।
সর্বনাশ ! মিনতিরা
যদি এরই মধ্যে
চলে যায় ? যাবার
সময় একবার দেখাও
হবেনা ?
কাল-বিলম্ব
না করে ও
রুদ্ধশ্বাসে ছোটে
আর ভগবানকে ডাকে,
‘ভগবান,
ওরা যেন চলে
না যায় ভগবান
! যাবার আগে যেন
একবার দেখা পাই,
আর কিছু নাহোক
অন্তত খোঁজটা তো
জানা যাবে ওরা
কোথায় যাবে ?’
হাঁপাতে
হাঁপাতে কালীঘরের
সামনে এসে থমকে
দাঁড়ায় কমল । ভগবান
ওর কথা শুনেছেন
। ওরা
তখনও যায়নি । কালীমার
সামনে পুঁজো দিচ্ছে
মিনতি ।
আজ একটু আগেই
। অন্যদিন
এসময়ে ও ঘর
ঝাট দিয়ে বাসি
ফুল, ধূপতির ছাই,
আধপোড়া ছোবড়া পরিষ্কার
করেই চলে যায়,
আর ন’টার
দিকে বড়দের কেউ
স্নান সেরে এসে
পূজা সারে ।
জাগ্রত
কালীমন্দির ।
অনেক দিনের পুরোনো
আসন ।
টিনের ছাপড়ায় হোগলা
পাতার তৈরি বেড়ায়
ঘেরা চতুর্দিক । সামনে
ফাঁকা মাঠ । পাড়ার
ছেলেমেয়েরা খেলাধুলা
করে ।
মন্দিরের পেছনে
বড় বড় আমের
গাছ ।
তারই ছায়ায় পূজারীরা
আরাধনা করেন মায়ের
। পাশে
দুর্গোৎসবের সময়
হয় পাড়ার সার্বজনীন
দুর্গোৎসব ।
গত
দুর্গোৎসবের আগে
একমাসব্যাপী প্রতিমা
বানানোর কাজ
করেছিল কার্ত্তিকদা । সে
সময় কার্ত্তিকদাকে
সঙ্গ দিতে গিয়েই
মিনতির সাথে ঘনিষ্টতা
বাড়ে কমলের । কার্ত্তিকদাকে
গল্পে, কথায় এবং
কাজে সাহায্য করতে
প্রায় প্রতিদিনই মন্দিরে
যেত ও । ওর
বয়সী আরও অনেকেই
ওখানে আসতো, তবে
তারা বেশীক্ষণ স্থায়ী
হতো না । সেখানে
বেশী সময় কাটাতো
কেবল কমল আর
মিনতি ।
বাচ্চাদের পুতুল
বানানোর জন্য
মাটি চাইতে এসে
বিভিন্ন ছল-ছুতোয়,
দুষ্টুমিতে মণ্ডপটি
প্রাঞ্জল করে
রাখতো মিনতি । আর
টিপ্পনী কাটতো
কমলের উদ্দেশ্যে – ‘কমলের
চুলটা কোপড়া কাটা’, ‘ঈশ, রাজ্জাক
হতে চায়!’, ‘কলেজে
পড়ে স্কুলের ছেলেদের
সাথে মিশে ক্যান?’, ‘ওনার
জামায় বেশী ডাঁট; বড়লোক
তো, তাই নতুন
নতুন শার্ট পড়ে’...
আরও কত কী!
এসব
কথায় কমল খুব
চটে যেত । কার্ত্তিকদা
মিটিমিটি হাসত
আর হাতের কাজ
করতো ।
একদিন
কার্ত্তিকদাই বলল,
‘কমলদা,
এসব কথায় আপনি
রাগবেন না । দেখবেন ও
আর বলবেনা । ও
আপনারে বলে মজা
পায়, আপনারে চেতায়
। আসলে
আপনারে ওর ভালো
লাগে’
।
আসলেও
তাই, কার্ত্তিকদার কথামতো
কাজ করে ফল
পাওয়া গেলো ।
কমল
একাদশ বিজ্ঞান বিভাগের
ছাত্র, আর মিনতি ক্লাস সেভেনে
। কমল
মিনতির দাদার বন্ধু
, সেই সাথে ভালো
ছাত্র ।
বিজ্ঞান নিয়ে
এস,এস,সি,
পাস করেছে । ইংলিশ
মিডিয়ামে এইচ,এস,সি,
পড়ছে ।
এসব কারণে মিনতিদের
শিক্ষিত পরিবারে
কমলের আদর-কদর
। সেজন্য
কমল আর মিনতির
কথাবার্তাকে কেউ অন্য চোখে দেখতো না ।
এতে
করে মিনতির মনে
অনুরাগ সৃষ্টি হতো
। আর
এই অনুরাগের ছোঁয়া
এক সময় কমলকে
দুর্বল করে দিত,
দুর্বল করে দিত
মিনতিকেও ।
এ দু’টি
দুর্বল মন সবসময়
চাইতো কারো কথায়
এবং কাজে কেউ
যেন ব্যথা বা
কষ্ট না পায়...
কমল
রাস্তায় দাঁড়িয়ে
অনেক কথাই ভাবলো
। এক
সময় পূজো সেরে
মিনতি পুজোর ঘরের
সামনে এসে দাঁড়ালো
। কমলকে
বলল, ‘মালপত্র গোজগাছ,
বাঁধা-সাধা শেষ
। দাদা
রিক্সার খোঁজে
গ্যাছে ।
আমি এসেছিলাম পূজো
সারতে ।
আমরা এক্ষুনি রওয়ানা
হব ।
আপনারা কোথায় যাচ্ছেন
?’
‘আমরা খুব
সম্ভব তুলাগ্রাম যাবো
। বাবার
এক দূঃসম্পর্কের
দাদার বাড়ি’ ।
‘তুলাগ্রাম তো
কাছেই’।
‘হ্যাঁ, চক
পাড়ি দিয়ে, মাত্র
দু’মাইল’ ।
‘কিসে যাবেন
?’
‘এতটুকুন পথ
। সম্ভবত
হেঁটেই ।
তোরা যাচ্ছিস কোথায়
?’
‘সদরদি’।
‘সদরদি কোথায়রে
?’
‘ভাঙ্গার ওদিকটায়’।
‘তাহলে তো
অনেক দূর !’
‘হ্যাঁ, আমাদের
দোকানের এক
কাস্টমারের বাড়িতে’।
কথোপকথনের এই পর্যায়ে ওরা মিনতিদের বাড়ি
পৌঁছে যায় । বাড়ির
ভেতর থেকে ডাক
আসে মিনতির । চঞ্চল
হয়ে ওঠে মিনতি
– ‘আসি
কমলদা’ ।
‘আচ্ছা । ভালো
থাকিস ।
তোর কথা ভীষণভাবে
মনে পড়বে । খুব
খারাপ লাগলে হয়তো
তোদের ওখানে যেতে
পারি’।
‘অত দূরে যাবেন
কি করে ?’
‘কই অত দূর
? মনের অনেক কাছেই
তো...’
আবারও
ডাক পড়ে মিনতির
। মিনতি
চলে যায় । যেতে
যেতে বলে, ‘বেঁচে
থাকলে দেখা হবে
। আমাকে
ভুলবেন না যেন!’
‘তোকে ভোলা
যায় না রে...’ কমলের কণ্ঠ
বাষ্পরুদ্ধ হয়ে
আসে ।
মিনতি বাড়ির গেটে ঢোকার সময় আর একবার কমলকে দ্যাখে । কমল হাত উঁচু করে সাড়া দেয় । বুকের ভেতরটা খাঁ-খাঁ করে ওর, মনে হয় ও কী যেন একটা খুব মূল্যবান জিনিস হারাতে চলেছে...
(চলবে)
No comments:
Post a Comment