খুঁজুন

Friday, March 17, 2017

কমলের একাত্তর / বাবু ফরিদী (৫)





কখন যে দোকানের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, তা টের পায়নি কমল দোকানের সামনে বড় একটি সাইনবোর্ড –‘কোহিনূর ফার্মেসী তার উপরে টিনের চাল থেকে প্রায় ফুট উপরে পতপত করে উড়ছে তল্লা বাঁশের সাথে বাধা স্বাধীন বাংলার লাল-সবুজ পাতাকা স্বাধীনতা ঘোষণার পর থেকে এটা চল্লিশ ঘণ্টা ধরে আকাশে উড়ছে  

আশেপাশের দোকানগুলোতে চোখ বুলায় কমল দেখে জয় বাংলার পতাকার স্থলে এখন উড়ছে চাঁদ-তারা খচিত পাকিস্তানি পতাকা! দু’-একটি দোকানে কোনো পতাকাই নেই
           
কমল দোকান খুলে পাকিস্তানি পতাকাটা খুঁজে বের করে তারপর দরজায় তালা ঝুলিয়ে স্ট্যান্ডের সামনে দাঁড়ায় জয় বাংলার পতাকা নামাবার উদ্দেশ্যে হাত রাখে স্ট্যান্ডে পতাকার দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ মনের অজান্তেই ওর দুচোখ উপচে জল আসে...

হঠাৎ পেছন থেকে কে একজন ধমকের সুরে বলে ওঠে, ‘শালা মালাউন ! নামা ওটা!’

কমল দেখলো ওর পেছনে একজন রিকশাওয়ালা কিন্তু তার সাথে এখন কোন রিক্সা নেই মনে কলো লোকটা হয়তো রিফিউজি হবে, তবে ওদের এলাকার কেউ নয় লোকটার কোমরে একটি ড্যাগার লক্ষ্য করলো কমল তারপর আস্তে আস্তে জয় বাংলার পতাকাটা স্ট্যান্ড থেকে খুলে ভাঁজ করে কোমরে গুজতে যাচ্ছিল , অমনি বাঁজপাখির মতো পতাকাটি ছোঁ মেরে নিয়ে নিল লোকটি মুখে বললো, শালা, হারামীর বাচ্চা, মরবার স্বাদ হইছে ? তারপর ওটা ছুঁড়ে ফেলে দিল নর্দমায় ভয়ে সমস্ত শরীর গেঁথে গেল কমলের দুরু দুরু বুকে বাড়ির দিকে পা বাড়ালো কিন্তু সামনে এসে দাঁড়ালো লোকটি রক্ত-চোখে ওর কাঁধের দিকে ইঙ্গিত করলো সম্বিত ফিরে পেলো কমল মনে পড়লো কাঁধে ঝুলানো পাকিস্তানি পতাকার কথা ভয়ে ভয়ে ওটি উড়ালো আকাশে
          
লোকটি এরপর পথ ছাড়ে কমল এগোয় বাড়ির উদ্দেশ্যে হঠাৎ ওর মনের পর্দায় ভেসে ওঠে মিনতির মুখ সর্বনাশ ! মিনতিরা যদি এরই মধ্যে চলে যায় ? যাবার সময় একবার দেখাও হবেনা ?
           
কাল-বিলম্ব না করে রুদ্ধশ্বাসে ছোটে আর ভগবানকে ডাকে, ভগবান, ওরা যেন চলে না যায় ভগবান ! যাবার আগে যেন একবার দেখা পাই, আর কিছু নাহোক অন্তত খোঁজটা তো জানা যাবে ওরা কোথায় যাবে ?
           
হাঁপাতে হাঁপাতে কালীঘরের সামনে এসে থমকে দাঁড়ায় কমল ভগবান ওর কথা শুনেছেন ওরা তখনও যায়নি কালীমার সামনে পুঁজো দিচ্ছে মিনতি আজ একটু আগেই অন্যদিন এসময়ে ঘর ঝাট দিয়ে বাসি ফুল, ধূপতির ছাই, আধপোড়া ছোবড়া পরিষ্কার করেই চলে যায়, আর টার দিকে বড়দের কেউ স্নান সেরে এসে পূজা সারে  

জাগ্রত কালীমন্দির অনেক দিনের পুরোনো আসন টিনের ছাপড়ায় হোগলা পাতার তৈরি বেড়ায় ঘেরা চতুর্দিক সামনে ফাঁকা মাঠ পাড়ার ছেলেমেয়েরা খেলাধুলা করে মন্দিরের পেছনে বড় বড় আমের গাছ তারই ছায়ায় পূজারীরা আরাধনা করেন মায়ের পাশে দুর্গোৎসবের সময় হয় পাড়ার সার্বজনীন দুর্গোৎসব
             
 গত দুর্গোৎসবের আগে একমাসব্যাপী প্রতিমা বানানোর কাজ করেছিল কার্ত্তিকদা সে সময় কার্ত্তিকদাকে সঙ্গ দিতে গিয়েই মিনতির সাথে ঘনিষ্টতা বাড়ে কমলের কার্ত্তিকদাকে গল্পে, কথায় এবং কাজে সাহায্য করতে প্রায় প্রতিদিনই মন্দিরে যেত ওর বয়সী আরও অনেকেই ওখানে আসতো, তবে তারা বেশীক্ষণ স্থায়ী হতো না সেখানে বেশী সময় কাটাতো কেবল কমল আর মিনতি
  
বাচ্চাদের পুতুল বানানোর জন্য মাটি চাইতে এসে বিভিন্ন ছল-ছুতোয়, দুষ্টুমিতে মণ্ডপটি প্রাঞ্জল করে রাখতো মিনতি আর টিপ্পনী কাটতো কমলের উদ্দেশ্যেকমলের চুলটা কোপড়া কাটা, ‘ঈশ, রাজ্জাক হতে চায়!, কলেজে পড়ে স্কুলের ছেলেদের সাথে মিশে ক্যান?, ওনার জামায় বেশী ডাঁট; বড়লোক তো, তাই নতুন নতুন শার্ট পড়ে... আরও কত কী!
          
এসব কথায় কমল খুব চটে যেত কার্ত্তিকদা মিটিমিটি হাসত আর হাতের কাজ করতো
          
একদিন কার্ত্তিকদাই বলল, কমলদা, এসব কথায় আপনি রাগবেন না দেখবেন আর বলবেনা আপনারে বলে মজা পায়, আপনারে চেতায় আসলে আপনারে ওর ভালো লাগে
            
 আসলেও তাই, কার্ত্তিকদার কথামতো কাজ করে ফল পাওয়া গেলো
            
 কমল একাদশ বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র, আর মিনতি ক্লাস সেভেনে কমল মিনতির দাদার বন্ধু , সেই সাথে ভালো ছাত্র বিজ্ঞান নিয়ে এস,এস,সি, পাস করেছে ইংলিশ মিডিয়ামে এইচ,এস,সি, পড়ছে এসব কারণে মিনতিদের শিক্ষিত পরিবারে কমলের আদর-কদর সেজন্য কমল আর মিনতির কথাবার্তাকে কেউ অন্য চোখে দেখতো না
           
এতে করে মিনতির মনে অনুরাগ সৃষ্টি হতো আর এই অনুরাগের ছোঁয়া এক সময় কমলকে দুর্বল করে দিত, দুর্বল করে দিত মিনতিকেও দুটি দুর্বল মন সবসময় চাইতো কারো কথায় এবং কাজে কেউ যেন ব্যথা বা কষ্ট না পায়...
           
কমল রাস্তায় দাঁড়িয়ে অনেক কথাই ভাবলো এক সময় পূজো সেরে মিনতি পুজোর ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালো কমলকে বলল, মালপত্র গোজগাছ, বাঁধা-সাধা শেষ দাদা রিক্সার খোঁজে গ্যাছে আমি এসেছিলাম পূজো সারতে আমরা এক্ষুনি রওয়ানা হব আপনারা কোথায় যাচ্ছেন ?
               
আমরা খুব সম্ভব তুলাগ্রাম যাবো বাবার এক দূঃসম্পর্কের দাদার বাড়ি
               
তুলাগ্রাম তো কাছেই
                
হ্যাঁ, চক পাড়ি দিয়ে, মাত্র দুমাইল
                
কিসে যাবেন ?
                
এতটুকুন পথ সম্ভবত হেঁটেই তোরা যাচ্ছিস কোথায় ?
               
 সদরদি
               
 সদরদি কোথায়রে ?

  ভাঙ্গার ওদিকটায়
                
 তাহলে তো অনেক দূর !
                  
হ্যাঁ, আমাদের দোকানের এক কাস্টমারের বাড়িতে

                  
কথোপকথনের এই পর্যায়ে ওরা মিনতিদের বাড়ি পৌঁছে যায় বাড়ির ভেতর থেকে ডাক আসে মিনতির চঞ্চল হয়ে ওঠে মিনতিআসি কমলদা’
                 
আচ্ছা ভালো থাকিস তোর কথা ভীষণভাবে মনে পড়বে খুব খারাপ লাগলে হয়তো তোদের ওখানে যেতে পারি
                  
 অত দূরে যাবেন কি করে ?
                  
 কই অত দূর ? মনের অনেক কাছেই তো...
                    
আবারও ডাক পড়ে মিনতির মিনতি চলে যায় যেতে যেতে বলে, বেঁচে থাকলে দেখা হবে আমাকে ভুলবেন না যেন!’
                   
তোকে ভোলা যায় না রে...  কমলের কণ্ঠ বাষ্পরুদ্ধ হয়ে আসে
                    
মিনতি বাড়ির গেটে ঢোকার সময় আর একবার কমলকে দ্যাখে কমল হাত উঁচু করে সাড়া দেয় বুকের ভেতরটা খাঁ-খাঁ করে ওর, মনে হয় কী যেন একটা খুব মূল্যবান জিনিস হারাতে চলেছে...                                              

(চলবে)

No comments:

Post a Comment