দু’মাইল পথ
পাড়ি দিতে ওদের
এক ঘণ্টারও বেশী
সময় লেগে যায়
। পথে
পাঁচ- ছ’বার
জিরাতে হয়েছে । সকলেই
পরিশ্রান্ত ।
গ্রামের বাড়িঘরের
ঝি-বউরা ওদের
দেখে বাড়ির পালানে
এসে দাঁড়ায় । বয়সী
মহিলারা ওদের
দুরবস্থা দেখে
আহাজারি করে
। কেউ
কেউ বাবাকে চিনতে
পেরে কুশলাদী জিজ্ঞাসার
সুরে অভিযোগ উত্থাপন
করে-
‘জন্মভিটা
ছাইড়া, ঐ যে
শহরে গেলা আর
এ মুখো হইলা
না, তবু এই
উছিলায় তোমার মুখখান
দেখলাম ।
তা, কতদিন থাকবা?
‘তা
বলা যায়না । শহরের
পরিস্থিতি ভালো
হলে চলে যাবো’।
‘হ, এইয়া
যে কবে ভালো
অবে! কী ভোট
যে দ্যাশে আইলো
!’
এরই মধ্যে চান্দুল্যা
নামে বাবার এক
বন্ধু সামনে এসে
দাঁড়ায়-
‘কী
দোস্ত, আমাগো কতা
তোমার মনে পইলো
? দোস্তনী ভালো
আছেন?’
–শেষ কথাগুলো মায়ের
উদ্দেশ্যে বলে
চান্দুল্যা কাকা
বাবার মাথার বোঝাটা
নিজের মাথায় তুলে
নিয়ে কমলদের সাথে
হাঁটতে থাকে ।
অল্প সময়ের মধ্যেই
ভোলা জ্যাঠার বাড়ির
উঠোনে পা রাখে
ওরা ।
ভোলা জ্যাঠা ও
তাঁর ছেলে বিশুদা বাড়িতেই ছিলেন
। তাঁরা
দ্রুত এগিয়ে এসে
কমলদের কাছ থেকে
বোঝাগুলো নিয়ে
ওদের হালকা করলেন
।
আমগাছ
তলায় খেজুরের পাতার
পাটিতে ওদের বসতে
দেন জেঠী । বিশুদা
দৌড়ে গিয়ে ঘর
থেকে তালের পাখা
নিয়ে এসে ওদের
বাতাস দিতে থাকেন
। কমল
বাবা-মায়ের সাথে
পাটিতে বসল । ছোটরা
কিছুক্ষণ বসে
উঠলো ।
এদিক-ওদিক ঘুরে
দেখতে লাগলো ।
কমলদের
আগমনবার্তা পেয়ে
নাপিতবাড়ির মেয়ে-পুরুষ
ক’জন এসে
ভীড় করলো । ও
বাড়ির পুরুষরা শহরে
গিয়ে খৌরকাজ করে
। আজ
তারা কেউ যায়নি
। তাদের
উদ্বেগটাও বেশী
। এরই
মধ্যে হিন্দু-মুসলমান
আরও অনেক মানুষ
ওদের দেখতে এলো
। তারা
সকলেই শহরের পরিস্থিতি
জানতে চাইলো । তাদের
কাছ থেকে জানা
গেল, ওদের মত
আরও আট-দশটি
পরিবার এরই মধ্যে
এ গ্রামে আশ্রয়
নিয়েছে ।
গোয়ালচামট এলাকার
মুসলমানপাড়া থেকে
বেশ কিছু গরু-বাছুর
এ গ্রামে সরিয়ে
এনেছে ।
বাবা তাদের প্রশ্নের
উত্তর দিতে থাকলেন
। মা
উঠে গেলেন জেঠীর
কাছে ।
লোকজন কমে গেলে
বাবা তার ছোটবেলার
বন্ধু চান্দুল্যা, শাহাজদ্দি,
ওসি, স্যাক –ওনাদের
সাথে গল্প-গুজবে
মেতে উঠলেন । কমল
বাড়ির চারদিকটা ঘুরে
দেখতে উঠে পড়লো
।
অল্প সময় পরে
মা এসে বাবাকে
স্মরণ করিয়ে দেন
আর এক বান্ডিল
কাঁথা-বালিশ তোষকের
বেডিং শহরের বাড়ি থেকে আনার
কথা ।
বাবা গল্পে ইস্তফা
দিয়ে কমলকে ডাকেন
। কমল
প্রস্তুতি নিয়ে
বাবার কাছে আসে
। জ্যাঠা
বাবাকে দুপুরের খাবার
খেয়ে যেতে বলেন
। জ্যাঠার
কথায় অন্যরাও আমল
দেয়- ‘এখন হুট
করে শহরে ঢোকা
ঠিক নয় । তারচে’
এ বেলাটা দেখে
দুপুরের পর
না হয় যাওয়া যাবে’
।
বাবা তাদের কথা
ফেলতে পারেন না
। স্থির
হয়, দুপুরের খাবার
খেয়ে ওরা দু’জন
আবার শহরে ঢুকবে, এখনও
যখন শহরে কিছু
মানুষ আছে!
রান্না হয়ে খাবার
খেতে খেতে দুপুর
গড়িয়ে যায় ।
বেলা তিনটায় ওরা
শহরের উদ্দেশ্যে পথে
নামে ।
খানিকটা পথ
এগুতেই দেখে মাঠের
মধ্যে কিছু লোকের
জটলা ।
সকলের চোখ দূরে
উত্তর-পশ্চিম বরাবর,
যেখানে ধোয়ার কুণ্ডলীর
মতো চোখে পড়ে
। লোকগুলো
বলাবলি করে, মিলিটারি
ফরিদপুর এসে
গেছে ।
মাঠের ওপাশ থেকে
নারী-পুরুষের সম্মিলিত
চিৎকার-রোল কানে
আসে ।
আরও খানিকটা এগুতেই
শেলের প্রচণ্ড শব্দ
শোনা গেল । পর্যায়ক্রমে
অনেকগুলো শব্দ
। গোয়ালচামট
এলাকা থেকে বিক্ষিপ্তভাবে
মানুষ গরুছাগল, বিছানাপত্র
নিয়ে চকে নামছে
। শত
শত মানুষ হাজার
পেরুতে থাকে । এক
সময় ঐ এলাকার
বাংলা ভাষাভাষী সব
অধিবাসীই চক
বরাবর বসতি ছাড়ে
।
No comments:
Post a Comment