খুঁজুন

Thursday, March 23, 2017

কমলের একাত্তর / বাবু ফরিদী (৮)


দুমাইল পথ পাড়ি দিতে ওদের এক ঘণ্টারও বেশী সময় লেগে যায় পথে পাঁচ- বার জিরাতে হয়েছে সকলেই পরিশ্রান্ত গ্রামের বাড়িঘরের ঝি-বউরা ওদের দেখে বাড়ির পালানে এসে দাঁড়ায় বয়সী মহিলারা ওদের দুরবস্থা দেখে আহাজারি করে কেউ কেউ বাবাকে চিনতে পেরে কুশলাদী জিজ্ঞাসার সুরে অভিযোগ উত্থাপন করে-

জন্মভিটা ছাইড়া, যে শহরে গেলা আর মুখো হইলা না, তবু এই উছিলায় তোমার মুখখান দেখলাম তা, কতদিন থাকবা?

তা বলা যায়না শহরের পরিস্থিতি ভালো হলে চলে যাবো

, এইয়া যে কবে ভালো অবে! কী ভোট যে দ্যাশে আইলো !

এরই মধ্যে চান্দুল্যা নামে বাবার এক বন্ধু সামনে এসে দাঁড়ায়-

কী দোস্ত, আমাগো কতা তোমার মনে পইলো ? দোস্তনী ভালো আছেন?’শেষ কথাগুলো মায়ের উদ্দেশ্যে বলে চান্দুল্যা কাকা বাবার মাথার বোঝাটা নিজের মাথায় তুলে নিয়ে কমলদের সাথে হাঁটতে থাকে

অল্প সময়ের মধ্যেই ভোলা জ্যাঠার বাড়ির উঠোনে পা রাখে ওরা ভোলা জ্যাঠা ও তাঁর ছেলে বিশুদা বাড়িতেই ছিলেন তাঁরা দ্রুত এগিয়ে এসে কমলদের কাছ থেকে বোঝাগুলো নিয়ে ওদের হালকা করলেন
          
          আমগাছ তলায় খেজুরের পাতার পাটিতে ওদের বসতে দেন জেঠী বিশুদা দৌড়ে গিয়ে ঘর থেকে তালের পাখা নিয়ে এসে ওদের বাতাস দিতে থাকেন কমল বাবা-মায়ের সাথে পাটিতে বসল ছোটরা কিছুক্ষণ বসে উঠলো এদিক-ওদিক ঘুরে দেখতে লাগলো
           
         কমলদের আগমনবার্তা পেয়ে নাপিতবাড়ির মেয়ে-পুরুষ জন এসে ভীড় করলো বাড়ির পুরুষরা শহরে গিয়ে খৌরকাজ করে আজ তারা কেউ যায়নি তাদের উদ্বেগটাও বেশী এরই মধ্যে হিন্দু-মুসলমান আরও অনেক মানুষ ওদের দেখতে এলো তারা সকলেই শহরের পরিস্থিতি জানতে চাইলো তাদের কাছ থেকে জানা গেল, ওদের মত আরও আট-দশটি পরিবার এরই মধ্যে গ্রামে আশ্রয় নিয়েছে গোয়ালচামট এলাকার মুসলমানপাড়া থেকে বেশ কিছু গরু-বাছুর গ্রামে সরিয়ে এনেছে

বাবা তাদের প্রশ্নের উত্তর দিতে থাকলেন মা উঠে গেলেন জেঠীর কাছে লোকজন কমে গেলে বাবা তার ছোটবেলার বন্ধু চান্দুল্যা, শাহাজদ্দি, ওসি, স্যাকওনাদের সাথে গল্প-গুজবে মেতে উঠলেন কমল বাড়ির চারদিকটা ঘুরে দেখতে উঠে পড়লো

অল্প সময় পরে মা এসে বাবাকে স্মরণ করিয়ে দেন আর এক বান্ডিল কাঁথা-বালিশ তোষকের বেডিং শহরের বাড়ি থেকে আনার কথা বাবা গল্পে ইস্তফা দিয়ে কমলকে ডাকেন কমল প্রস্তুতি নিয়ে বাবার কাছে আসে জ্যাঠা বাবাকে দুপুরের খাবার খেয়ে যেতে বলেন জ্যাঠার কথায় অন্যরাও আমল দেয়- এখন হুট করে শহরে ঢোকা ঠিক নয় তারচে’ বেলাটা দেখে দুপুরের পর না হয় যাওয়া যাবে’
বাবা তাদের কথা ফেলতে পারেন না স্থির হয়, দুপুরের খাবার খেয়ে ওরা দুজন আবার শহরে ঢুকবে, এখনও যখন শহরে কিছু মানুষ আছে!

রান্না হয়ে খাবার খেতে খেতে দুপুর গড়িয়ে যায়

বেলা তিনটায় ওরা শহরের উদ্দেশ্যে পথে নামে খানিকটা পথ এগুতেই দেখে মাঠের মধ্যে কিছু লোকের জটলা সকলের চোখ দূরে উত্তর-পশ্চিম বরাবর, যেখানে ধোয়ার কুণ্ডলীর মতো চোখে পড়ে লোকগুলো বলাবলি করে, মিলিটারি ফরিদপুর এসে গেছে মাঠের ওপাশ থেকে নারী-পুরুষের সম্মিলিত চিৎকার-রোল কানে আসে

আরও খানিকটা এগুতেই শেলের প্রচণ্ড শব্দ শোনা গেল পর্যায়ক্রমে অনেকগুলো শব্দ গোয়ালচামট এলাকা থেকে বিক্ষিপ্তভাবে মানুষ গরুছাগল, বিছানাপত্র নিয়ে চকে নামছে শত শত মানুষ হাজার পেরুতে থাকে এক সময় এলাকার বাংলা ভাষাভাষী সব অধিবাসীই চক বরাবর বসতি ছাড়ে
         

        মাঝপথে কমলের চলৎশক্তি রহিত হয়ে যায়
                          
কোমরপুর বরাবর একটি হেলিকপ্টার আকাশে উড়তে দেখা যায় মনে হয় মিলিটারি ট্রাকের পাহারায় এগুলো আসছে স্থানে স্থানে কুণ্ডলীকৃত ধোয়া উড়তে দেখা যায় জনপদ থেকে আকাশে, সাথে আগুনের লেলিহান শিখা ছোপ ছোপ কালো ধুঁয়া আকাশের রং বদলে দেয় উড়ন্ত হেলিকপ্টার থেকে জন ছত্রীসৈন্য নামতে দেখা যায় রাজবাড়ী রাস্তার মোড়ের ওদিকটাতে হাটের মতো মানুষ চকে অবস্থান নিয়ে অবলোকন করে সেসব দৃশ্য সবার মনে ভয়-উৎকণ্ঠা দানা বাঁধে ঘরবাড়িছাড়া মানুষ কান্নার রোলে আল্লাহ্কে ডাকে, মুক্তি চায় আর সমূহ বিপদের অপেক্ষায় কালক্ষেপণ করে
 
        কমলের বুক শুকিয়ে কাঁঠ হয়ে যায় বাবার মুখের দিকে তাকায় অস্রুসজল চোখে বাবা বলেন, কমল, সব শেষ হয়ে যাবে রে!   

 

(চলবে)

No comments:

Post a Comment