এমন অবস্থার মধ্যে
ছটফট করতে করতে
ভোর হলো। ভোরের
পাখিরা কিচিমিচি শব্দ
তুলে ঘুম থেকে
জাগালো। আস্তে
আস্তে রাতের ভয়ানক
আবহটা কমে এলো। পাখির
মিষ্টি ডাকে প্রাণবন্ত
হয়ে উঠলো সকাল-- টিঁ টুঁই...
টিঁ টিঁ টুঁই...
টিঁ টুঁই টিঁ
টিঁ টুঁই...
কমল বিছানা ছাড়ে। পায়ে
পায়ে উঠোন পেরিয়ে
জেলা বোর্ডের রাস্তায়
দাঁড়ায়। এদিক-ওদিক
তাকায়। পুবের
আকাশ আবীর রঙে
রাঙানো। এখনও
সূর্য দেখা যাচ্ছে
না। কিছুটা
দূর থেকে ক’জনের
কথোপকথন ভেসে
আসে। কমল
সেদিকে এগোয়। ওদের
কাছে এসে যে
কথাগুলও ওর
কানে এলো, তার
জন্য কখনই প্রস্তুত
ছিল না কমল। শ্রীঅঙ্গনের
ক’জন সাধুকে
নাকি গত সন্ধ্যায়
মিলিটারিরা মেরে
ফেলেছে।
কমল আঁতকে ওঠে। বিষ্ণুর
খবর জানার জন্য
মনটা ব্যাকুল হয়ে
ওঠে, কিন্তু একটা
দ্বিধাও কাজ
করে ওর মনে। ওকে
কি ওরা মেরে
ফেলেছে কিনা, দ্বিধাটা
এই নিয়েই। ওর
মনে পড়ে চিরবন্ধুর
কথা। কমলের
চেয়ে ৯-১০
বছরের বড় হলেও,
ওর সাথেই প্রাইভেট
দিয়ে কলেজে পড়ছে। পরীক্ষার
কারণে ওদের পরিবারের
সাথে তার ঘনিষ্টতা
বেড়েছে। আহা,
চিরবন্ধু ব্রহ্মচারীর
যদি কিছু হয়!
বেশিক্ষণ ভাবতে
হলো না ওকে। লোকজনের
কথাবার্তা থেকে
জানা গেলো, ‘গত
রাতে অমরবন্ধু ব্রহ্মচারী
আর বিষ্ণু মিলে
একটি ছেলে এ
গ্রামে আশ্রয় নিয়েছিল। ভোর
না হতেই তারা
চণ্ডীপুরের দিকে
ছুটেছে’।
কমল বিষ্ণুর খবর
জেনে আশ্বস্ত হলেও,
চিরবন্ধু ব্রহ্মচারীসহ
অন্য সাধুদের সম্বন্ধে
ওর সংশয় রয়েই
গেলো।
রাস্তায় লোক
সমাগম বাড়তে থাকে। বাড়তে
থাকে দিনের আলো। নানা
ধরনের প্রবাদ, রূপকথা,
উপমা, লোকগল্প-গুজবের
মধ্যে উদ্বেগ আর
উৎকণ্ঠায় কাটে
সময়। কেউ
কেউ মনগড়া উক্তি
দিয়ে স্বাধীনতার পিন্ডি
দেয়, নিকুচি করে। সমূহ
বিপদের জন্য ছাত্রসমাজকে
দায়ী করে অশিক্ষিত-বর্বর
মানুষ এই অবস্থা
থেকে পরিত্রাণ কামনা
করে। এমনকি,
কেউ কেউ ঠাট্টাচ্ছলে
এও বলে—‘সেক
কইছে না আমরা
ভাতে মারবো, পানিতে
মারবো? হওয়ার আর
দ্যাখছো কী?
আমাগো ভাতে-পানিতেই
মারবি!’
এভাবেই কেটে যায়
সমস্ত দিন। সন্ধ্যার
দিকে আসে শহরের
খবর। কাল
শান্তি মিছিল হবে। বলা
হয়েছে, যারা দুষ্কৃতিকারীদের
পক্ষে নয়, তারা
যেন মিছিলে আসে। যদি
গ্রাম বাঁচাতে হয়,
মিছিলে বেশি লোক
দেখাতে হবে। মাথায়
থাকবে টুপি, হাতে
চাঁদ-তারা পতাকা।
এ খবরে খুশি
হয় সকলেই। কমলরাও
স্বস্তির নিঃশ্বাস
ফেলে। আয়োজন
চলে আগামী দিনের
মিছিলের।
মিছিল শেষে ধোপদুরস্ত
পোষাকে হর্ষ-উৎফুল্ল
লোকজন ঘরে ফিরলো। কেউ
কেউ লুটের মাল
নিয়ে চক কোনাকুনি
ফিরছে বলেও শোনা
গেলো। এমনকি
কারো মাথায় দেখা
গেলো শ্রীঅঙ্গনের বড়
বড় লোহার কড়াই!
কমল বাবার সাথে
এগিয়ে গেলো তাদের
দিকে। শহরে
ফেরার ব্যাকুল আগ্রহে
তাদের সাথে কথা
বলতে চাইল। কিন্তু
না, আশানুরূপ সাড়া
মিললো না। একদিন
মিছিলে গিয়েই বাবার
বন্ধুদের দু-একজন
বাদে বাকি সবাই
যেন প্রভু হয়ে
গেলো! বাবার বন্ধু
চান্দুইল্যা গোপনে
অনেক কথা বলে
শেষে বললেন, ‘আইজ
জুম্মার নামাজ
আছে ঈদের জামাতের
মতো’।
ওছি কাকা বললো,
‘কালীপদ, শহরের জীবন
যাপনের তালিমডা এহন
থিকা ভুইলা যাও। গ্রামের
ভাষায় কথাবার্তা কওয়া
আবার চালু করো
সবাই, আমাগো সাথে
মিশা যাও’।
গ্রামে আশ্রয় নেয়া
মানুষ দ্বিধাবিভক্ত
হয়ে পড়ে শহরের
খবর শুনে। কমল
আর ওর বাবা
চান্দুইল্যা কাকা
ও ওসি কাকার
কথা শুনে নির্জীব
হয়ে পড়ে। মুসলমান
শহুরে পরিবারের পুরুষরা
অনেকেই ইতিমধ্যেই নিরাপদে
শহরে ঢুকে গেছে। বাকিরা
শহরে যাবার পথ
খুঁজছে। ভাসা
ভাসা আওয়ামী লীগ
সমর্থকরা নিকটস্থ
আত্মীয়-স্বজনদের খোঁজ
নিচ্ছেন, যারা
কোনো না কোনোভাবে
পিস কমিটির সদস্যদের
সাথে সম্পৃক্ত। হিন্দু
এবং দাগী আওয়ামী
লীগারদের শহরে
ফেরার কোনো পথ
আপাতত নেই। মেয়েদের
ব্যাপারটাও অনুরূপ। কমবয়সী
মহিলা এবং উঠতিবয়সী
মেয়েদের শহরের
বাড়িতে নেবার কথা
কেউ ভাবছে না।
হিন্দু পরিবারগুলো আরও
ভেতরে আশ্রয় নেবার
চিন্তা-ভাবনা করছে। গ্রামের
কেউ কেউ আজ
রাতের মধ্যেই তাদেরকে
অন্যত্র চলে
যেতে বলছে। কারণ
তাদের মতে, তাদের
জন্য এ গ্রামের
বিপদ আসতে পারে। কেউ
কেউ তাদের সোনা-দানা,
নগদ অর্থ, উঠতি
বয়সের মেয়েদের ওপর
সজাগ দৃষ্টি রাখছে।
আবার
কেউ কেউ ভাবছে
অন্যরকম, বলছে—‘আহারে,
কী সব মানুষ
এ গ্রামে আইছে!
বিপদ না আইলে,
লাখ টাকা খরচ
কইরাও তো আমরা
তাগো এই গ্রামে
আনবার পারতাম না!’
মারোয়ারি পরিবারের
ঝি-বউদের দুরবস্থার
কথা উল্লেখ করে
কেউ কেউ আবেগাপ্লুত
হয়ে যায়। বলে,
‘কাইয়াগো বউগুলানের
পাও ফুইলা কলা
গাছ। তারা
কি কুনদিন এত
পথ হাঁটছে? এহন
তারা কেমনে অন্য
জাগায় যাবে? মালপত্র
নয় আমরা দিয়া
আসলাম, ওনারা কি
এত হাঁটতে পারবে?’
না পারলেও তো
পারতে হবে। তাই,
কোনো কোনো হিন্দু
ব্যবসায়ী পরিবার
স্থানীয় মানুষ
সাথে করে রাতেই
নিরাপদ স্থানে সরে
যেতে উদ্যত হয়। কেউ
কেউ থেকে যায়
পরের দিনের অপেক্ষায়।
(চলবে)
No comments:
Post a Comment