পরদিন ভোরে কমল
কিছু মুখে দিয়ে
ভাবুকদিয়া মেঝ
পিসির ওখানে যাবার
অনুমতি নেয় মায়ের
কাছ থেকে। বিষুদার
কাছ থেকে বাইসাইকেলটা
চেয়ে নেয়। কিন্তু
ভাবুকদিয়া না
গিয়ে ও ছোটে
চণ্ডীপুরের দিকে,
উদ্দেশ্য বিষ্ণুর
সাথে দেখা করা।
পথে নামতেই অনেক
ধরণের খবর জানতে
পারলো কমল। চাকী
বাড়িতে নাকি কোন
ব্যবসায়ী সোনা
পুতে রেখে গেছে
দুই সের। মারোয়ারি
পরিবারগুলো নাকি
সোনাদানা টাকা-পয়সা
গ্রামবাসীর হাতে
দিয়ে তাদের সহায়তায়
দক্ষিণে চলে
গেছে ভোর রাতেই। এরকম
অনেক খবর বিলি
কেটে কমল এগিয়ে
যায়।
খাল-খন্দর পারি
দিয়ে গ্রামের ভেতর
দিয়ে অনেক ঘুরে
ও যখন চণ্ডীপুর
পৌঁছল, তখন বেলা
১১টা। রাস্তার
পাশের এক বাড়িতে
বিষ্ণুর খোঁজ
পাওয়া গেলো। দেখাও
মিললো এক সময়। ওকে
দেখে বিষ্ণু হাউমাউ
করে কেঁদে ফেললো। কমল
ওকে জড়িয়ে ধরলো। জানতে
চাইলো চিরবন্ধুর কথা,
শুনতে চাইলো শ্রীঅঙ্গনের
হত্যাকান্ডের কথা। বিষ্ণু
প্রকৃতস্থ হয়ে
সব বলতে লাগলো
একে একে—
একুশ তারিখ যে
ফরিদপুরে মিলিটারি
আসছে, তা অমরদা
১৯ তারিখেই পাঠক
বাবুর কাছ থেকে
জানতে পেরেছিলেন। পাঠক
বাবু আঙ্গিনায় ভক্তাবাসে
এসে দু’একদিন
থেকে নিরাপদ আশ্রয়ের
সন্ধান করছিলেন। এমতাবস্থায়
কী করা উচিৎ
তার কিছুই ঠিক
করতে পারছিলেন না
অমরদা। প্রিয়দা,
বন্ধু কমলদা, প্রকাশদা
ও নন্দদার সাথে
আলোচনা করে তিনি
স্থির করলেন, ২০
তারিখ ভোরে প্রভুর
রক্ষিত দেহ নিয়ে
গ্রামের ভেতর
দিয়ে ২৫ মেইল
পথ পায়ে হেঁটে
মাচ্চর ইউনিয়নের বাকচর
শ্রীঅঙ্গনে পৌঁছাতে
হবে। সেই
মতে মঙ্গলবার ভোরে
প্রভুর দেহ একটা
কাঠের বাক্সে নিয়ে,
শ্রীঅঙ্গনের দক্ষিণ
দিকের গ্রাম দিয়ে
কয়েকজন সাধুসহ বাক্সটি
বাকচর পাঠান। কিন্তু
বাকচরের একজন
প্রভাবশালী ব্যাক্তির
সামনে অমরদার জীবন
নিরাপদ ছিলো না
বিধায় গোপনে সুধন্য
মোহন্তকে পাঠানো
হলো সেখানে, যেন
ওদের আচরণ লক্ষ্য
করে ফিরে এসে
অমরদাকে সাবধান
করা যায়।
তারপর অমরদা কাঁধে
একটা ব্যাগ ঝুলিয়ে
সন্তর্পণে পা
রাখলেন শ্রীঅঙ্গনের পোস্ট
অফিসের সামনের রাস্তায়। দেখলেন
কজন বিহারি শ্রীঅঙ্গনের
ওপর কড়া নজর
রাখছে আর সাধুদের
গতিবিধি লক্ষ্য
করছে। অমরদাকে
তাদের একজন বললো,
‘অমরদা, কোথায় যান?’
অমরদা তাঁর গতি
পরিবর্তন করে
বললেন, ‘ভাঙ্গা। সামনে
উৎসব, তাই কিছু
টাকা-পয়সা চাল
সংগ্রহের চেষ্টায়
যাচ্ছি’।
কিন্তু এ কথায়
বিহারিরা খুশি
হলো না। অমরদা
ঝিরি ঝিরি বৃষ্টির
মধ্যে হাঁটতে
হাঁটতে পূর্বখাবাসপুরে
এক পণ্ডিত বাবুর
বাড়িতে উঠলেন। সেখানে
গিয়ে তাঁকে একুশ
তারিখের আশু
বিপদের খবর জানালেন
এবং তাঁকে নিরাপদে
সরে পড়তে বলে
একটা রিক্সায় উঠে
রিক্সাটা কাপড়
দিয়ে জড়িয়ে ছুটলেন
বাকচরের উদ্দেশ্যে।
শ্রীঅঙ্গনের কাছাকাছি
আসতেই, বিহারিরা রিক্সা-আরোহীর
পরিচয় জানতে চাইলো। রিক্সাওয়ালা
জানালো, রিক্সায় মিয়াঁবাড়ির
লোক। এ
কথা শুনে বিহারিরা
আর কিছু বললো
না। রিক্সা
ধেয়ে চললো। সাধুরা
দুপুরের আগেই
প্রভুর দেহ নিয়ে
বাকচর পৌঁছে গেলো,
অমরদা পৌঁছলেন সন্ধ্যার
কিছু আগে। তিনি
সেখানকার সেবাইতকে
বললেন, বাক্সটিতে সংক্ষেপে
ফুল-জল দিয়ে
পূজা দিতে। এমন
সময় রাখাল নামের
এক ভক্ত ছুটে
এসে জানালো, মোল্লা
সাহেবের লোকজন
অমরদার আগমন টের
পেয়ে গেছে!
অমরদা সাধুদেরকে আশু
বিপদের কথা স্মরণ
করিয়ে দিয়ে বললেন,
‘আমি যেখানে যে
অবস্থাতেই থাকি
না কেন, তোমরা
প্রভুর দেহ নিয়ে
পরিস্থিতি বুঝে
গ্রামের ভেতর
দিয়ে যশোর রোড
এবং রেলপথের মাঝ
দিয়ে কলকাতার উদ্দেশ্যে
ছুটবে। বেঁচে
থাকলে সেখানেই দেখা
হবে’।
সেদিন অমরদা হাটগোবিন্দপুরে
রাত্রিযাপন করলেন। পরদিন
ভোরে গুড়ি গুড়ি
বৃষ্টির মধ্যে
রওয়ানা দিলেন ফরিদপুরের
উদ্দেশ্যে। পথিমধ্যে
বন্ধু কমলদা ও
ক্ষিতিবন্ধুদাকে গ্রামের
দিকে ছুটতে দেখা
গেলো। তারা
জানালেন, শহর
এখন মৃতের পুরী। শ্রীঅঙ্গনের
সাধুরা এতোকিছুর মাঝেও
কীর্তন চালিয়ে যাচ্ছে
বলেও তারা জানান।
অমরদা বন্ধুকমলদা ও
ক্ষিতিবন্ধুকে নিয়ে
দু’টা রিক্সায়
করে আঙ্গিনার দিকে
ছুটলেন। সেখানে
পৌঁছে বেলা ১০টা
৩০ মিনিটের দিকে
অমরদা শ্রীঅঙ্গনের মঠের
চুড়ায় উঠলেন। দেখলে,
গোয়ালন্দ-খানখানাপুর
এলাকায় কিছু কিছু
ঘরবাড়িতে দাউ
দাউ করে জ্বলছে
আগুন। তিনি
নিচে নেমে এসে
সাধুদের জড়
করলেন একত্রে। তারপর
বললনে, ‘এখানে থাকলে
মৃত্যু অনিবার্য। তোমরা
যার যার মত
পালাও’।
তবে বেশিরভাগ সাধুর
বক্তব্য ছিল,
‘কপালে মৃত্যু থাকলে
এখানেই মরবো। প্রভুর
শ্রীধাম শ্রীঅঙ্গন
ছেড়ে যাবো কোথায়?
প্রভু মৃত্যু রাখলে
ঠেকাবে কার সাধ্য?’
অমরদা তাঁদের ওপর
প্রভাব খাটালেন না। বন্ধুকমলদা
তিন-চারজন সঙ্গীসহ
কানাইপুরের ভেতর
দিয়ে বাকচরের উদ্দেশ্যে
রওয়ানা হলেন। এমন
সময় এলেন চিরবন্ধু
ব্রহ্মচারী। তাঁকে
দেখেই তাঁকে তাঁর
বোনদের সাথে পালানোর
পরামর্শ দিলেন
অমরদা। কিন্তু
সে পালাতে নারাজ। তখন
অমরদা সকলের উদ্দেশ্যে
বললেন, ‘যারা মৃত্যু
অনিবার্য জেনেও
এখানে থাকতে চাইছো,
তারা একত্রে মন্দিরের
ভেতর গিয়ে প্রভুর
নামকীর্তন করতে
থাকো।
অমরদার কথামতো এগারজন
সাধু মন্দিরের ভেতর
ঢুকলেন। অমরদা
আর আমিও তাঁদের
সাথে মন্দিরে অবস্থান
নিলাম। তারপর
দরজা ভালোভাবে বন্ধ
করে দিলাম। দু-একটি
জানালা বাইরের পরিবেশ
দেখার জন্য খোলা
রেখে অন্যগুলো বন্ধ
করে দিলাম।
বেলা আড়াইটার দিকে
রাজবাড়ি রাস্তার
মোড় এলাকায় শেলিং-এর
শব্দ শোনা গেলো,
সাথে গুলি। ছরবর
ছরবর করে গাছের
পাতার ভেতর দিয়ে
বৃষ্টির মতো
গুলি ছুটতে থাকলো। শেলগুলো
শহরের দিকে পড়ছে
বলে অনুমান করলাম। তখন
আমাদের কীর্তনে কেমন
যেন বিচলিত ভাব
ফুটে উঠলো। এমন
সময় পূর্বদিকের জানালার
পথের মাথায় সাদা
ফিতা আর হাতে
ধারালো অস্ত্রধারী কজন
বিহারির দেখা
মিললো। ওরা
আমাদের কীর্তন বন্ধ
করতে বললো। কিন্তু
আমরা কীর্তন থামালাম
না। উপর্যুপরি
ধমক দেওয়া হলো
আমাদেরকে, কীর্তন
থামানোর জন্য।
ওদের হাতের ধারালো
অস্ত্র দেখে ভাবলাম
আমাদের মৃত্যু আসন্ন। একজন
বিহারি অমরদাকে ডাকলো। অমরদা
দরজা খুলে বেরিয়ে
গেলেন। বললেন,
‘কী চাও তোমরা?’
অমরদার পেছনে হরিবলদা,
সুকুমারদার সঙ্গে
আমিও বেরিয়ে এলাম। বিহারিরা
আবারও কীর্তন বন্ধ
করতে বললো। অমরদা
বললেন, ‘দ্যাখো, তোমাদের
জন্মের আগে থেকে
এখানে রাত্রিদিন কীর্তন
চলছে, এই কীর্তন
চলবে’।
(চলবে)
No comments:
Post a Comment