হঠাৎ
করেই কানটা সজাগ হয়ে যায় বাস্তবতায়। কমলের বাবা শুয়ে শুয়েই ওর মায়ের সাথে কি
যেন বলাবলি করছেন। কান খাড়া করে ও।
‘শব্দগুলো কতদূরে হচ্ছে বলে মনে
করো ?’ – মার গলা।
বাবা
বলছেন, ‘গোয়ালন্দ ঘাটের বরাবরই তো মনে
হয়’।
‘ওগুলো কিসের শব্দ ?’
‘কী জানি ? শুনেছি শেল বা
মর্টারের শব্দ এ রকম হয়, আবার কামানও হতে পারে, ঠিক করে বলা মুশকিল । তবে ওসব অস্ত্র আমাদের নেই’ ।
‘তাহলে উপায় ? যদি মিলিটারি
ঢুকে পড়ে ?’
‘কি আর করা ? সকলের যা হয় আমাদেরও
তাই হবে’।
‘আবার কি রায়ট হবে?’
‘কি যা-তা হবে বলছো ? এটা কি
হিন্দু মুসলমানের ব্যাপার, যে রায়ট হবে ? এটা হোল পাকিস্তানি শাসকদের সাথে
বাঙালিদের বোঝাপড়ার ব্যাপার । এখানে হিন্দু-মুসলমান আমরা
সবাইতো বাঙালি । আমরা একযোগে পাকিস্তানি
মিলিটারিদের প্রতিহত করবো । মিলিটারি
ক’জন
আছে এদেশে ? আর আমরা সাড়ে সাত কোটি । তাছাড়া ফরিদপুরে ওরা সহজে
আসতে পারবে না’।
‘তুমি যতই বল আমার কিন্তু ভয়
করছে । এতগুলো পোলাপান নিয়ে কি হবে এখন ? যদি ওরা এসেই
পড়ে!’
‘এসেই যদি পড়ে, তখন এখান থেকে
পালাতে হবে’।
‘তবে যে বললে ফরিদপুরে ওরা সহজে
আসতে পারবেনা!’
‘কারণ গোয়ালন্দ ঘাটে আমাদের আনসার পুলিশ বাহিনী ওদের মোকাবেলা করবে । সেভাবেই ওরা প্রস্তুত আছে’।
‘ওহ! ঠাকুর, রক্ষা করো ঠাকুর। মা দুর্গা, রক্ষা করো’।
মায়ের
আর্তিতে চোখ দু’টো ছলছল করে কমলের । হাতের তালুতে তা মুছতে মুছতে
বিছানার উপর উঠে বসে । এমন সময় উঠোনের উপর দিয়ে
দুপদাপ শব্দে ক’জন মানুষ কথা বলতে বলতে হেঁটে যায়--- দু’একটি অস্পষ্ট কথা কমলের
কানে ঢোকে,
‘ছালাহ্- শুয়োরকা বাচ্চা-বাঙালি
আদমি’।
মা
বাবাকে শুধালো , ‘ওরা কারা ?’
‘বিহারি রিফিউজিরা বলেই তো মনে
হোল’।
‘ওরা কোথায় যায় ?’
‘রাস্তার দিকেই তো মনে হোল’ ।
‘ওরা কি আমাদের ক্ষতি করতে পারে?’
‘পারেই তো’।
অল্প
সময় পরে নিকটস্থ মসজিদ থেকে আযানের ধ্বনি ভেসে এলো—‘আসসালাতু খায়রুম মিনান নাউম...’
আরও
একটু পরে উঠোন বেয়ে কে একজন হেঁটে এসে ওদের দরজার সামনে দাঁড়ালো ।
কমলের
বাবা উচ্চকণ্ঠে বলে উঠলো, ‘কে ? কে ওখানে ?’
‘কালীপদ্দা আমি’।
কমল
টের পেল প্রতিবেশী ধীরেন সমাদ্দারের গলা। বাবা বিছানা ছেড়ে দরজার দিকে
এগিয়ে গেলেন। তারপর হেরিক্যানের আলোটা
উস্কে দিয়ে দরজা খুলে দিলেন। সাথে সাথেই ঘরের ভেতর ধুকে পড়লেন ধীরেন সমাদ্দার। পেছনে তার স্ত্রী ।
সমাদ্দার
বললেন, ‘ভোর হয়ে গেছে , এখন আর বাতির
প্রয়োজন নেই। নিবিয়ে দিন হেরিক্যানটা’।
কমলের
বাবা জানালা খুলে দিয়ে ঘরের বাতি নিভিয়ে দিলেন। তারপর অনুচ্চ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেমন মনে করছেন? আমি অনেকক্ষণ
জেগে, কিন্তু কারো সাড়া-শব্দ না পেয়ে ঘাপটি মেরে বিছানায় পড়ে ছিলাম। ক’জন বিহারি এদিক দিয়ে গেল, টের পেয়েছেন?’
‘হ্যাঁ । খবর খুব ভালো না। সকালের মধ্যেই বাড়িঘর ছেড়ে চলে যেতে হবে। আমি বিহারিদের আওয়াজ পেয়ে জানালা খুললাম
নিঃশব্দে, দেখলাম ওদের হাতে ধারালো রামদা, ড্যাগার...!’
একথা
শুনে আড়কে উঠলেন মা ; কমল ও ওর বাবার সাহস মরে গেল। তিনি
অসহায় শিশুর মত বলে ফেললেন, ‘আপনার গ্রামের বাড়ি আছে , সেখানে গিয়ে ভাই-ব্রাদার-মার
কাছে উঠবেন। আমাদের তো কিছুই নেই। হাতের-পাতের খুইয়ে শহরের এ বাড়িটি করেছি। একবার বাড়ি করলাম, নামমাত্র মূল্যে একোয়্যার ( acquire) করলো
ওয়াপদা (পানি উন্নয়ন বোর্ড, ফরিদপুর)। আবার করলাম এখানে। তাও ছেড়ে যেতে হবে! বাড়িঘর ছেড়ে গেলে কি কিছু
আস্ত থাকবে? সাথে টাকা পয়সাও নেই কোথায় যাবো, কি খাবো?’
‘এখন অতকিছু চিন্তা করার সময় নয়। কোথাও গিয়ে জীবনে বাঁচতে হবে। তারপর এসব আবেগী কথাবার্তা। উঠুন। তৈরি হয়ে নিন’।
‘আচ্ছা ধীরেন দা, তবে যে শুনলাম
গোয়ালন্দ ঘাটে আমাদের শক্ত ব্যূহ তৈরি করা হয়েছে , খানসেনারা দক্ষিণাঞ্চলে ঢুকতেই
পারবে না ? তবে এত শীঘ্রই আমরা বাড়িঘর ছাড়ছি ক্যানো ?’
‘আরে দাদা আমি যখন বাড়ি থেকে
পালিয়ে যাই, তখন তো আমি সেনবাহিনীতে চাকরি নেই । ৬৫-এর যুদ্ধও আমি নিজ চক্ষে দেখেছি । পাকিস্তানি বাহিনী এত দুর্বল নয়, যে দুই-চারটা
থ্রি-নট-থ্রি, রামদা , গুলতি, তীর-ধনুক আর
ঐ টুটু বোর, ছড়ড়া-- ওগুলো দিয়ে বাচ্চাদের ভয় দেখানো যায়, যুদ্ধ করা যায় না । তাছাড়া আমরা হিন্দু । আমাদের ভয় বেশী’ ।
‘কেন ? আমাদের ভয় বেশী কেন ?
বাঙালি হিন্দু-মুসলমান সকলের স্বার্থ যেখানে নিহিত, সেখানে আমরা একা কেন পালাব ?’ – বাবার ভেতর সন্দেহ।
(চলবে)
No comments:
Post a Comment