(১৩টি খন্ডের পর)
বিষ্ণুর কাছ
থেকে বিদায় নিয়ে
কমল ডেরার উদ্দেশ্যে
পথে নামে। সন্ধ্যার
আগেই ফিরতে হবে। নইলে
মা চিন্তা করবেন,
আর বাবা মাকে
বকবেন।
সাইকেল চালাতে চালাতে
কমলের বুকের ভেতর
থেকে যেন হু
হু করে কষ্টের
বাতাস বের হয়। এক
এক করে ওর
সামনে ভেসে ওঠে
আটজন সাধুর মুখচ্ছবি।
চিরবন্ধু, বয়স
পঁচিশের কোঠায়। প্রাইভেট
পাশ করে একাদশ
মানবিকের ছাত্র
ছিলেন। দেখা
হলেই জয় জগদ্বন্ধু
বলে এক গাল
হাসি হেসে কুশলাদি
জিজ্ঞেস করতেন। কমলের
মায়ের সাথে আলাপ
হলে তিনি কমলের
সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন
দেখাতেন তাঁকে। কমলের
পরিবারের সাথে
আগে থেকেই ঘনিষ্ঠ
তিনি। তাঁর
জামাইবাবু একজন
পুলিশ। তাদের
সাথে আবার কমলের
দিদিমার খুব
ভাব। একই
স্থানে বসবাস করেছেন
অনেকদিন।
অন্ধ কানাইবন্ধু ব্রহ্মচারী,
খুব ভালো বাঁশি
বাঁজাতে পারতেন। একা
পথ চলতে চলতে
হারিয়ে যাবার উপক্রম
হলেই ‘জয় জগদ্বন্ধু’
বলে চিৎকার করতেন। স্বজনেরা
এসে তাঁকে পথ
দেখিয়ে দিত, অথবা
সাথে করে গন্তব্যে
পৌঁছে দিতো। তাঁর
ঘুম ভাঙতো খুব
সকালে, কোনো কোনোদিন
রাত থাকতেই। শ্রীঅঙ্গনের
চতুর্দিক দিয়ে
হাঁটতেন আর
চিৎকার করে বলতেন,
‘জয় জগদ্বন্ধু!’ একদিন
ভোর চারটার দিকে
বারবার শোনা গেলো
তাঁর চিৎকার।
প্রায়
এক ঘন্টা এভাবে
চিৎকার চললো, প্রতিবেশীদের
কারো কারো ঘুমে
ব্যাঘাত সৃষ্টি
হলো। কিছু
শক্ত-মন্দ বলার
উদ্দেশ্যে তারা
টর্চ হাতে ঘর
থেকে বের হলো। তারা
দেখলো, কানাইদা সেই
মাঘ মাসের শীতে
বাগানবাড়ির পুকুরে
বুক সমান জলে
দাঁড়িয়ে। ব্যাপার
কি জানতে চাইলে
কানাইদা জানালেন,
আজ রাত থাকতেই
যে তাঁর ঘুম
ভেঙেছে, তা তিনি
টের পান নি। ঘর
থেকে বেরিয়ে হাঁটতে
হাঁটতে অনেক সময়
পরেও যখন পাখির
ডাক-কলকাকলী শুনতে
পেলেন না, তখন
তাড়াতাড়ি আবার
ঘরে ফেরার চেষ্টা
করতে গিয়ে পা
ফসকে পুকুরে পড়ে
যান।
একথা শুনে কি
আর কারো রাগ
থাকে? সবাই তাঁর
সেবা-শুশ্রুষায় বাকি
রাতটুকু কাটিয়ে
দিলো। আর
এক ঘন্টা এভাবে
থাকলে ঐ রাতেই
তাঁর মৃত্যু হতো!
আর একজন সাধু
ছিলেন বোবা। খুব
রাগী ছিলেন তিনি। অবসর
সময়ে বসে বসে
তুলসীর মালা তৈরি
করতেন। দলবল
নিয়ে শ্রীঅঙ্গনে ‘অত্যাচার’
চালাতো বলে, কমলের
ওপর ছিলো তাঁর
ভীষণ রাগ। হঠাৎ
করেই ক্রমে ক্রমে
ভাবটাও কমলের সাথেই
হলো বেশি। ছুটির
দিনে তিনি কমলকে
তাঁর কাছে বসিয়ে
রাখতেন। প্রভুর
ভোগ সম্পন্ন হলে
প্রসাদ এনে কমলকে
খাইয়ে তবেই বিদায়
দিতেন।
আর একজন ক্ষিতিবন্ধু
ব্রহ্মচারী। ফর্সা
লাল টকটকে চেহারা,
ভীষণ রগচটা মানুষ
ছিলেন তিনি। কমলরা
তাঁর সামনে পড়লেই
পুলিশের মতো
জেরা করতেন, ‘কী
চাস? ফুল বাগানে
কী করিস? যা!’
অনেক মস্তানও এমন
জেরার ভয়ে তাঁর
সামনে আসতে সাহস
পেত না।
এমনি করে সবার
স্মৃতিই ভাসতে
লাগলো কমলের চোখে। চোখের
পাতা ভিজতে গিয়েও
ভেজে না, শুধু
ভারি হয়ে আসে। ঝাপসা
হয়ে আসে দৃষ্টি। এভাবেই
ভাবতে ভাবতে গ্রামের
ভেতর দিয়ে ঘুরে,
তখন সন্ধ্যা হতে
আর মাত্র আধঘন্টার
মতো বাকি। নাপিত
গ্রামের কাছে
আসতেই, ও সাইকেল
থেকে নামলো। দেখলো,
দরবেশের জলার
সংযোগ খালটির ওপরের
বাঁশের সাঁকোতে বাঁশ
নেই। অথচ
সকালবেলায়ও এই
বাঁশের ওপর দিয়ে
কমল সাইকেলসহ পার
হয়েছে। আর
মাত্র একশ গজ
দূরে জ্যাঠাদের বাড়ি। এখন
কীভাবে ওপারে যাবে, কমল
তা ভাবতে থাকে।
হঠাৎ দূরে মানুষের
শোরগোল শোনা যায়। সাথে
চিৎকার, কান্নার রোল। ক্রমশ
স্পষ্ট হয়। নিকটে
আসে এক মিছিল
মানুষের আওয়াজ। কমল
কিছু বলে ওঠার
আগেই, ওর চেয়ে
পাঁচ-ছয় বছরের
বড় একটি ছেলে
কমলের হাত থেকে
সাইকেলটি ছিনিয়ে
নেয়। তারপর
ওর হাত ধরে
খালসংলগ্ন একটি
বাড়িতে গিয়ে ঢোকে। দুজন
মহিলা কমলকে টেনে
নিয়ে একটি গোয়ালঘরের
ভেতর রেখে দরজার
ঝাপ আটকে দেয়।
কমল বোকাচন্ডির মতো
গোয়ালঘরের ভেতর
দাঁড়িয়ে চারদিক
পরখ করে। ওর
কানের পর্দায় আঘাত
করে কয়েকজন মহিলা-পুরুষের
ফিসফিস আওয়াজ। উঠোন
থেকে ভেসে আসছে। কমল
বেড়ার সাথে কান
লাগিয়ে কথাগুলো শোনে,
‘শহর থেকে খানসাব,
বিহারিসাব, বাঙ্গালিসাব
নামে তিনজন লোক
আইছিলো চৌধুরী বাড়িতে
মাইয়া নেবার। গ্রামের
লোক নেবার দেয় নাই। তাগো
লগে নাকি মারপিট
করছে। দুইজনরে
বাইন্ধা থুইছে। একজন
যাইয়া শহরে খবর
নিছে। আর
যাবা কোথায়? আইজই
অরা আসতর পাইছে। গ্রামের
মানুষ তো হাতে-পায়ে
ধুইয়া মাফ পাইছে,
যত ঝাল মিটতেছে
এহন হিন্দুগ্যার পরদ্যা’।
এরই মধ্যে ধাপুর ধুপুর পায়ে লোকজন ছোটাছুটি করে। এদের কেউ কেউ কমলের পরিচিত। খালের পার দিয়ে তারা ছোটে দক্ষিণ হয়ে পূর্বে। হঠাৎ ‘টাশ’ করে গুলির শব্দ হয়। কমল বেড়ার ফাঁকে চোখ রাখে। দেখে, ওর ভোলা জ্যাঠা মাটিতে পড়ে ‘বাবাহ্বাবাহ্’ বলে গড়াগড়ি যাচ্ছে। রক্তে লাল হয়ে গেছে তাঁর সাদা জামা।
অন্য একজন লোক তাঁর গলায় ছুরি চাপিয়ে চলেছে, ‘শালা মালাউন, বাবা কওয়াই...’
(চলবে)
No comments:
Post a Comment