[আগের ১৮ পর্বের পর]
গৌরদিয়া গ্রামে থমথমে ভাব বিরাজ করে। দুপুর পর্যন্ত কাইজ্যা চলে। শোনা
গেলো, আগন্তুকরা ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছে। ওদেরও আহত হয়েছে অনেক। এ গ্রামে আহতের
সংখ্যা বিশের উপরে। দু’জনের অবস্থা আশংকাজনক। বাঁশের সাথে কাঠ ঝুলিয়ে তাদের
চিকিৎসার উদ্দেশ্যে নেয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে।
সারা রাত গ্রাম পাহাড়া চলে। সর্বত্র সতর্কাবস্থা। কেউ যেন গ্রামে ঢুকতে না পারে। কমলরা উদ্বেগের সাথে
রাত কাটায় দাসবাড়ি। ভুঁইয়াবাড়ির লোকজন এবাড়ি ওবাড়ি সরে থাকে। সরিয়ে ফেলা হয়
মূল্যবান সামগ্রী।
ভোরে ভুঁইয়াবাড়ির সবাই আবার মিলিত হলো একত্রে। সকালবেলাই কাতরা হাতে
কয়েকজন সঙ্গীসহ আফছার এলো পিসামশাইর কাছে। বলল, ‘বাবু, আপনাগো আর নাকপার পারলাম
না’।
পিসামশাই চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ায়। তাঁর চোখে-মুখে বিহ্বলতা। আফছার আবার
বলে, ‘নুট আমরাই হরুম। আপনারা জান নিয়া সইরা দাঁড়ান’।
কাকিমা ঘরের ডানদিকে উঠানের একটি চুলায় পাতিলে ধান সেদ্ধ করছিলেন। মা তাকে
চোখ ইশারা করেন। কাকিমা মায়ের ইশারামতো চুলোর কয়লা সরিয়ে আধাসিদ্ধ ধানগুলো চুলোয়
ঠেলে চুলোর পর পাতিল চাপিয়ে সরে যায় মায়ের পাশে। দিদিমা, পিসি কাঁদতে কাঁদতে উঠোনে
নামেন।
ইতিমধ্যেই শুরু হয় লুট। পঞ্চাশ-ষাটজনের একটি দল চড়াও হয় বাড়িতে। ‘মার মার’
শব্দে কাঠের বেড়া খুলতে থাকে ওরা। তারপর একে একে লুটে নেয় সর্বস্ব।
এক ঘন্টার মতো সময় ধরে চলে লুট। শেষমেশ এক মহিলা কাকির রাখা চুলোর সেই
ধানগুলো তুলতে থাকে পাতিলে। কাকি তাকে বাধা দিতে যান। কাকুতি মিনতি করে বলেন,
‘দেখো, ঐ ধান কয়ডা থুইয়া যাও! আমাগো পোলাপানগুলা এহনও কিছু খায় নাই’।
তারস্বরে চেঁচিয়ে উঠলো মহিলা, ‘দ্যাহো, ঐ মাগী কয় কী! মাগীগো এততো মানষি
নুট হইরলো, তা মাগীর সইলো। আর আমি এই ধান কয়ডা নিছি, তা ওর সয় না!’
মা কাকিকে চুপ করতে বলেন। কাকি চুলোর দিকে এগিয়ে যান, হঠাৎ ‘ও মাগো’ বলে
আর্তচিৎকার দিয়ে বসে পড়েন মাটিতে। মা দৌড়ে তার কাছে যান। দেখেন, উঠোনে ছড়ানো কাঠের
বেড়ার চিৎ হয়ে থাকা গজাল লোহার অর্ধেকটা কাকির পায়ে ঢুকেছে। মা তাড়াতাড়ি সেটা টান
মেরে খুলে ভগবানের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘হা ভগবান! এই কি তোমার বিচার?’
ফিনকি দিয়ে কাকির পা থেকে রক্ত ঝরে। বাড়ির সবাই ভিড় জমায় কাকির চারদিকে।
কেউ গাঁদা ফুলের পাতা খোঁজে, কেউ আনে দূর্বা। এভাবে কাকির শুশ্রূষা চলে অনেকক্ষণ
ধরে।
ওদের ভাগ্যে খাবার জুটলো না দিনভর। সন্ধ্যার আগে ওরা সরে যায় ভুঁইয়া বাড়ি
থেকে। ওঠে মেকো দাসের বাড়ি। রাতে সে বাড়ি থেকে কিছু দানাপানি জোটে ওদের। রাত ন’টায়
আফছার এলো দাসবাড়ি। বাবার খোঁজ নিয়ে তার কাছে গেলো। বললো, ‘মশায়রা, তোমরা এহনও যাও
নাই? যদি জানের মায়া থাহে, তয় সকালের মধ্যে এ গ্রাম ছাড়বা’।
আফছার হন্হন্ করে চলে গেলো। কমলের মা ওর বাবার শরীরে মৃদু ধাক্কা দেয়।
বাবা-মায়ের মাঝে চোখাচোখি হয়। মা বললেন, ‘আফছার তোমারে তুমি কইরা বললো?’ বাবা
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মাথা নামায়।
রাতে বাবার কথা হলো কাকার সাথে। কথা হলো পিসামশাই ও দাদু-দিদিমার সাথে। সিদ্ধান্ত হলো, মরতেই যদি হয়
তবে দেশের দিকে গিয়ে মরি। বাবা বললেন, ‘মান-সম্মানই যদি না থাকলো, তখন বেঁচে থেকেই
বা লাভ কি?’
কাকা বললেন, ‘শহরের কাছের এলাকা এখন নাকি নিরাপদ। বিপদ ঢুকছে এখন গ্রামের
ভেতর, প্রত্যন্ত অঞ্চলে, অজো পাড়াগাঁয়।
ভোর না হতেই কমলরা পেছনের দিকে ছুটলো। উদ্দেশ্য আপাতত ভাবুকদিয়া, তারপর
ফরিদপুরের কাছাকাছি কোথাও। কিন্তু কাকিকে নিয়ে হলো ভীষণ বিপদ। জং ধরা গজাল লোহার
খোঁচা বলে কথা। পায়ের তলা ফুলে ঢোল হলো। তবু তো যেতে হবে! অতি কষ্টে খুঁড়িয়ে
খুঁড়িয়ে, কমলের মায়ের কাঁধে ভর দিয়ে তিনি চলতে লাগলেন পথ।
সকাল সাতটা-আটটা লাগলো ওদের ভাবুকদিয়া পৌঁছতে। প্রথমেই মা দৌড়ে গেলেন
মেঝপিসির কাছে। কাকির পায়ের অবস্থা দেখিয়ে বললেন, ‘দ্যাখেন ঠাকুরমশাই, বাদলের এই
অবস্থা। তাই আজকের মতো আপনার এখানে থাকবো। কাল সকালেই আমরা অন্য কোনোখানে চলে যাবো’।
পিসামশাই ভালো-মন্দ কিছু বললেন না। পিসি প্রতিবেশীর কাছ থেকে সরিয়ে রাখা
চাল থেকে কিছু চাল আনলেন। উনুনে চড়ালেন রান্না। রান্না শেষে খাওয়া-দাওয়াও হলো।
কিন্তু বাবা-কাকা ভীষণ চিন্তায় পড়লেন কাকিকে নিয়ে। দিনে ও রাতে দশবারের মতো গরম
লবণ জলের সেক দেয়া হলো। পাকানো কাপড়ের সলতে সরষের তেলে ভিজিয়ে তাতে আগুন জ্বলে
কাকির পায়ের তলায় পিটানোও হলো বহুবার।
আস্তে আস্তে ব্যাথাও কিছুটা কমে এলো এক সময়।
আবারও ভোরে শুরু হলো পথ চলা। রাতের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এবার গন্তব্য
সোমসপুরের কাছাকাছি বেতবাড়িয়া। কাকির পক্ষের আত্মীয় চিত্ত রায়ের বাড়ি। তাম্বুলখানা
ফুরসার মাঝামাঝি পুবের গ্রাম।
সেখানে পৌঁছে প্রথম ক’দিন তাদের খাবারই খেলো ওরা। গ্রামে হিন্দু পরিবারের
সংখ্যা মাত্র দু-তিন ঘর। অবস্থাসম্পন্ন বলতে গেলে এরাই। বিশ-ত্রিশ বিঘা জমির মালিক
চিত্ত বাবু। কিছু জমি নিজে চষে বাকিটা গ্রামের লোকের কাছে বর্গা দেয়া। গ্রামের
মানুষের সহানুভূতি আছে তার উপর। তাছাড়া তিনি গ্রামের মানুষের বিপদ-আপদও দেখেন।
বিহারি-মিলিটারি আতংক হয়নি এখনও।
কমলরা সব দিক ভেবে এখানে থাকাটা নিরাপদ মনে করলো। একটু এদিক-ওদিক ঘোরাফেরা
করতে পারলে খাবারের কোনো কষ্টই হবে না। কৈজুরী, আকোইন, ভাটপাড়া, ঘোড়াদহ, মঙ্গলকোট
এখান থেকে কাছেই। ওসব গ্রামে কাকার পরিচিত কাঠের ব্যাপারী ফড়িয়া, মিষ্টির দোকানের
দুধ যোগানদার বাবার রোগী, পুরাতন বর্গাদার বন্ধু-বান্ধব অনেকেরই বাড়ি। তাদের কাছে
গেলে একভাবে না একভাবে চলেই যাবে দিন।
কমলের বাবা-কাকা এগ্রাম-সেগ্রাম করতে থাকেন। ফেরার সময় কিছু হাতে করে নিয়ে
ফেরেন। কমল-সুভাষও বসে থাকে না। সকালে শুরু হয় গ্রামের দিকে উদ্দেশ্যহীন যাত্রা,
আবার সন্ধ্যার আগেই বাড়ি ফেরার তাগিদ। আজ মঙ্গলকোট, কাল ভাটপাড়া তো পরশু অমুক
গ্রাম।
এভাবেই কাটে বেশ কিছুদিন। কোনোমতে জোটে দুটি পরিবারের দুবেলা আহার। গমের
খিচুরী আর শাকপাতা। মাঝে মধ্যে খিচুরীর মধ্যে যোগ হয় কাঁচা কাঠালের তরকারী।
বাবা-কাকা ও কমল-সুভাষ গম-ছোলা আনেন। মা-কাকি সেসব ঢেঁকি-জাতায় পিষে খোসা ছাড়ান।
প্রথম প্রথম খোসা ছাড়ানো গম আর ছোলার খিচুরী পেটে সহ্য হতো না কারো। এখন এসব
ছোট-বড় সবার কাছেই মানানসই হয়ে গেছে। যতটা হাদ্য, ততটা মল। এ থেকেই বেঁচে থাকে
শরীর। কেটে যায় দীর্ঘ আড়াই মাস সময়...
[চলবে]
No comments:
Post a Comment