(১৪টি খন্ডের পর)
কিছুক্ষণের মধ্যে
নিষ্প্রাণ হয়ে
যায় কমলের জ্যাঠার (বড় চাচা) দেহ। ‘মার!
মার!’ -শব্দে মানুষ
এগিয়ে যায়। দাউ
দাউ করে জ্বলে
ওঠে আগুন। পোড়ে
বাড়িঘর। আরও
গুলির শব্দ হয়। কমল
বাবার জন্য অস্থির
হয়ে ওঠে। ঘর
থেকে বেরুতে গিয়ে
কমল ভীরের মাঝে
কোমর গলিয়ে জ্যাঠাকে
দেখে। চমকে
ওঠে ও। একজন
জ্যাঠার জামাটি
খুলে নেয়। আর
একজন তাঁর ধুতি
খোলে! কমল চোখ
নামায়। আবার
চোখ তোলে। দেখে,
অন্য একজন লোক
জ্যাঠার দেহটা
খালের জলের মধ্যে
নামিয়ে দেয়।
ভোলা জ্যাঠার করুণ
পরিণতি কমলকে ভেতরে
ভেতরে শাসায়। কিছুক্ষণ
দম বন্ধ করে
থাকে ও। বুকের
ভেতর গুমড়ে মরে
কান্না। এ
মুহূর্তে এক
কলস পানির পিপাসায়
ছটফট করে ও। বাইরে
ঝড়ো বাতাস বয়। কিছু
সময়ের ভেতর আকাশ
কালো করে মেঘ
হয়। বৃষ্টি
নামে অঝোরে। স্তিমিত
হয়ে আসে শোরগোল-চিৎকার।
সন্ধ্যার কিছু
পরে বৃষ্টি থামে। বাবার
জন্য ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে
কাঁদে কমল। গোয়ালঘর
থেকে বেরুতে চায়
একটা সময়। ঐ
ছেলেটিই ওকে
বাসায় পৌঁছে দেয়। মা
ওকে পেয়ে বুকে
জড়িয়ে ধরে চিৎকার
করে কাঁদেন, ‘ও
কমল, তোর বাবা
হয়তো বেঁচে নেই!
তোর জ্যাঠাকে মেরে
ফেলেছে! আমাদের কী
হবেরে...’
কমল পাথর হয়ে
যায়। জেঠী
কাঁদছে, সবাই কাঁদছে। কান্নার
ফাঁকে ফাঁকে অসংলগ্ন
কথা বলতে থাকে
মা, ‘তোর জন্য
আমি যে কী
চিন্তায় ছিলামরে
বাবা... আবার
ভাবছি ভাবুকদিয়া যাইয়া
ও বাঁচছে। কে
জানি আমার শাখা
খুইলা, সিন্দুর মোচাইয়া
দিয়া নাপিতের বাড়িতে
দিয়া আসলো। এরই
মধ্যে দেখি কত
মানুষ! কে যে
কোথায় গেলো...
শেষ পর্যন্ত সবাই
ফিরে আসলো; আসলো
না শুধু তোর
বাবা, জেঠা আর
কনক... হায়
কনক! ঐ বাচ্চা
ছেলেটা যদি বেঁচেও
থাকে, কোথায় আছে
কে জানে? নাকি
অন্ধকারে ডুইবা
মরে...’
হঠাৎ বিষুদা চেঁচিয়ে
ওঠে, ‘আসেন তো
কাকিমা’।
বাইরে অস্ফুট আওয়াজ
শোনা যায়। মা
কান্না থামায়। সবাই
চুপ হয়ে যায়। বিষুদা
দরজার ভাঙা পাল্লাটা
ঠেলে উঠোনে নামে। পেছন
পেছন জেঠী, মা
ও কমল। উঠোনের
শেষ দিকে আন্ধকারে
ছায়ার মতো কিছু
একটা নজরে পড়লো
সবার। বিষুদা
এগিয়ে যায় সেদিকে,
পেছনে কমল। বিষুদা
চিৎকার করে ওঠে,
‘আপনি বেঁচে আছেন
কাকা! বাবা নাই...’
বিষুদা বাবার কাঁধে
মাথা রেখে কাঁদে। ছুটে
আসে মা। কমলের
বাবার হাত থেকে
ওর ছোটভাই কনককে
তুলে নেয়। বাবাও
কাঁদেন। কাঁদেন
জেঠিমা। কুপি
হাতে কাঁদতে কাঁদতে
ঠাকুমা আসেন।
বাবা বেঁচে
আছেন জানতে পেরে
প্রতিবেশীরা ছুটে
আসে। সবাইকে
বাবা তাঁর বেঁচে
ফেরার কাহিনী শোনান—
‘যারা এসেছিলো,
তাঁদের অনেকেই আমার
চেনা। তাই
আর দৌড়-টৌর
দেইনি। ওরা
যখন বড় ঘরে
আগুন দিয়ে পরেরটাতে
আগুন দিতে যাবে,
তখন কে যেন
চিৎকার করে ঐ
ঘরে আগুন দিতে
নিষেধ করলো। আমি
ঘরের পেছন থেকে
উঠোনের দিকে আসছিলাম। দেখি
লুটপাট শুরু হয়ে
গেছে। কবিরপুরের
একটি লোক, দেখলে
চিনি কিন্তু নাম
জানি না—সে
এসে আমার দিকে
দা উঁচিয়ে কোপ
ঝাড়ে। আমি
মাথা নিচু করে
কনককে টান দিয়ে
দৌড় দিতে গেছি,
এমন সময় আবারও
চিৎকার শোনা গেলো,
‘সামনে যাও’।
লোকটি যাবার সময়
আমার পায়ে তার
হাতের লাঠি দিয়ে
আঘাত করে যায়। আমি
ব্যাথায় কুকিয়ে
উঠি এবং মাটিতে
বসে পড়ি। এমন
সময় আমাদের ওখানকার
হযরত আলী নামে
একজন লোক আমাকে
টেনে তুলে বললো,
‘ডাক্তার বাবু,
আপনারে তো ওরা
মাইরা ফেলাবে! আমার
সাথে আসেন’। আমি
ভাঙা পায়ে খুঁড়িয়ে
খুঁড়িয়ে তার
সাথে ছুটলাম। লোকটি
মাঠের মধ্যে ক্যাওড়া
গাছের ঝোপের ভেতর
আমাকে আর কনককে
লুকিয়ে রেখে চলে
গেলো। কিন্তু
ক’জন বিহারি কিশোর
আমাকে দেখে ফেলে। ছুটে
এসে আমার সামনে
নানা রকম অঙ্গভঙ্গি
করতে থাকে। ওরা
আমার চোখে দিকে
তাকিয়ে অস্ত্র ঘুরায়
আর ওদের ভাষায়
কী যেন বলে। আমি
আমার আর কনকের
চোখ রক্ষায় প্রাণপণ
চেষ্টা করি।
এমন সময় একটি
ছেলে সবাইকে নিশ্চুপ
করে আমাকে প্রশ্ন
করে, ‘আপনি কি
কমলের বাপ আছেন?’
আমি বললাম, ‘হ্যাঁ
বাবা। আমি
কমলের বাবা। তুমি
আমার ছেলেকে চেন?’
ছেলেটি বললো, ‘আমার
নাম রাজা। কমল
আমার বন্ধু আছে। ও
কোথায়?’ আমি বললাম,
‘ও তো ভাবুকদিয়া
গেছে, বাবা!’
ছেলেটি আমার ওপর
সদয় হলো। অন্য
ছেলেদেরকে আমার
কাছ থেকে সরে
যেতে বললো। কিন্তু
ছেলেগুলো আমার
চোখ উপড়ে নেয়ার
বাসনায় অটল ছিলো। রাজা
প্রতিবাদ করলো। এক
পর্যায়ে ওদের
মধ্যে শুরু হলো
মারামারি হাতাহাতি। আমি
ভগবানকে ডাকতে
লাগলাম যে, ভগবান,
রাজার যেন কোনো
ক্ষতি না হয়। ততক্ষণে
ওদের বড়রা চলে
গেছে অনেক দূরে। তাছাড়া
বাতাস বইছে, আকাশে
ঘন মেঘ। ওরা
আর ঝামেলা না
করে আমাকে ফেলে
চলে গেল। রাজাও
চলে গেল। শুরু
হলো বৃষ্টি। আমি
বৃষ্টি শেষ হলে
উঠে দাঁড়ালাম। হাঁটতে
চেষ্টা করলাম। কিন্তু পারলাম না। অনেক কষ্টে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এই এলাম।
বাবাকে ধরে ঘরে
আনা হলো। মা
তার পায়ে তেল
ডলতে লাগলেন। কমল
বর্ণনা করতে থাকলো
ভোলা জ্যাঠার মৃত্যুর
বীভৎস কাহিনী, আর
লোকটা কীভাবে ওকে
লুকিয়ে রেখে ওর
নিরাপত্তা নিশ্চিত
করেছিল সেই কথা। এরই
মধ্যে আরও কয়েকজনের
মৃত্যুর সংবাদ
শোনা গেলো। শোনা
গেল বাড়িঘর জ্বালাবার
কথা, বলা ডাক্তারের
মৃত্যু সংবাদ, কবিরপুর
তুলাগ্রাম পিয়ারপুর
মুন্সীরবাজার এলাকার
সর্বমোট ছত্রিশ
জনকে গুলি করার
সংবাদ। জানা
গেল অশ্বিনী ঠাকুর
আর হারান ঠাকুরের
তলপেটে গুলিবিদ্ধ হবার
সংবাদ। এভাবে
বাড়তে লাগলো রাত
আর বাড়তে লাগলো
সংবাদের বহর।
(চলবে)
No comments:
Post a Comment