খুঁজুন

Monday, April 24, 2017

মুক্তিযুদ্ধের চাক্ষুষ ঘটনা নিয়ে বাবু ফরিদীর উপন্যাস 'কমলের একাত্তর' [পার্ট ২০]





[আগের ১৯টি পর্বের পর]
একদিন বিছানায় শুয়ে কমলের ঘুম এলো না। মিনির জন্য মনটা যেন কেমন করলো। আগেও অনেকবার মিনির কথা মনে হয়েছে, কিন্তু নানা প্রতিকূলতা ও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় তা মিলিয়ে গেছে। মনে মনে মিনির জন্য ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেছে, ওরা যেন ভালো থাকে। অথচ আজ মিনি কিছুতেই ওকে ছাড়ছে না। মনে হয় বিছানায় পাশেই মিনি। ওর নিঃশ্বাস যেন সেই দুর্গা মন্ডপের অনুভএখন, এই অসময়ে ও কমলের সমস্ত মন-প্রাণ উদ্দীপিত করে। মনে হয় মিনির অশরীরী আত্মা ওকে ঘিরেই আবর্তিত হচ্ছে যেন। কমল চিন্তিত হয়। তবে কি মিনির কোনো বিপদ? মিনি কি তাহলে...

আর ভাবতে চায় না কমল। মিনি ওকে যতই বিরক্ত করুক, কমল ওকে ভুলে থাকবে। মিনিরা ভালো আছে এ ধারণা নিয়েই ভুলে থাকবে। এ মুহূর্তে সাহসের উপর ভর করেই চলতে চায় ও। মৃত্যু যদি আসে তো হঠাৎ করেই আসুক। দুশ্চিন্তার মধ্যে উদ্বেগের মধ্যে সময় কাটালে মৃত্যুর আগেই তো মৃত্যু হয়ে যায়। নিজের কিংবা অন্য কারো মৃত্যুর ভয় বা সংবাদে এখন ওআর টলতে চায় না। হাজার হাজার মানুষ যেখানে হত্যা হচ্ছে, লক্ষ লক্ষ ঘরবাড়ি যেখানে লুটপাট –অগ্নিসংযোগ হচ্ছে, সেখানে কোনো হত্যা-লুণ্ঠন অগ্নিসংযোগ শুধু আভিধানিক অর্থের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। 

তবুও মিনির কোনো দুঃসংবাদ কমলের কাছে নিজের মৃত্যুর মতোই শীতল।
কমল বিছানায় কিছুক্ষণ ছটফট করলো। তারপর নিজের থেকেই চিন্তা ঘুরিয়ে নিলো অন্যদিকে। একেবারে দোরগোড়ার বাস্তবতায়। আড়াই মাস দ্বারে দ্বারে ঘুরে চেয়ে-চিন্তে, আবার স্মৃতিময় বাস্তবতায়। কিছু কিছু ঘটনা ওর মনের আয়নায় ভেসে ওঠে, যা শুকতারার মতো জ্বলজ্বলে হয়ে থাকবে ওর জীবনে। যেদিন দেশ সত্যি সত্যি স্বাধীন হবে, সেদিন থেকে এসব দুঃখ-দুর্দশার স্মৃতিময় অতীত পাহারা দেবে গদিনশীলরাজন্যের, যাতে বসন্তের কোকিলরা কোনোক্রমেই যুক্তবৃক্ষে বসে মিষ্টি মিষ্টি ডাকের আবেশে উতলা না করতে পারে স্বাধীনতাপ্রিয় মানুষকে।

সুভাষ বরাবরই একটু লাজুক স্বভাবের। আর একটু বিলাসপ্রিয় মানুষ। চেয়ে-চিন্তে খাওয়া বা চাওয়ার মতো মানসিকতা ওর নেই। যেখানে বাড়ির বড় ছেলে হিসাবে স্বচ্ছল পরিবারে না চাইতেই অনেক পেয়েছে, সেখানে শত কষ্টেও মুখ ফুটে কিছু চাওয়া ওর জন্যে ছিলো কঠিন কাজ। এ কাজটি করানোর জন্য অনেকদিন অপেক্ষা করতে হয়েছে কমলদের। কমলও যে চেয়ে-চিন্তে খাওয়ায় অভ্যস্ত, তা নয়। তবে কমল বাস্তববাদী। তাইতো সুভাষকে বাস্তবের মুখোমুখি দাঁড় করাতে সময় লেগেছে ওর। যেন সুভাষ অকপটে বলতে পারে, ‘এই যে, কিছু সাহায্য দেবেন?’ কমল তো একমাস যেতে না যেতেই একেবারে ঘুমের মধ্যেও বলে বসতো, ‘এই যে, কিছু সাহায্য দেবেন?’

প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে হাত-মুখ ধুয়ে ওরা সোজা ছুটতো বেতবাড়িয়া থেকে পূবে। তারপর প্রকান্ড বটগাছটা থেকে এক একদিন এক এক গ্রাম ঘুরতো। আজ ঘোড়াদহ, কাল আকোইন, পরশু ভাটপাড়া-- এভাবে। সাত সকালে যে ক’টা ছোলা পাওয়া যেতো, তা কোনো গেরস্তবাড়ি থেকে ভেজে টাকটুক করে চিবুতে চিবুতে দ্বারে দ্বারে ঘুরতো। ছোলা ভাজাই ওদের এই সময় পর্যন্ত সকালের নাস্তা। তারপর সন্ধ্যার আগেই ওরা ফিরতো আস্তানায়। চাউল পাওয়া যেত না বললেই চলে। সাতদিনে হয়তো এক সের চাল মিলতো। গম, ছোলা পাওয়া যেত বেশ। আটাও পাওয়া যেত সামান্য।
প্রতিদিন ওরা দুজনে গড়ে চার সের গম আর পাঁচ সের ছোলা ভিক্ষে করে আনতো। তারপর সন্ধ্যায় গমের খিচুরী খেয়ে ক্লান্ত শরীরে সে কী সুন্দর ঘুম! এক ঘুমে একেবারে ভোর।

যারা চাল দিতো, তারা কোনো না কোনোভাবে কাছের মানুষ জেনেই দিতো। হয়তো সুভাষদের শহরস্থ মিষ্টির দোকানের দুধওয়ালা, নয়তো ওর দাদুর পাট ব্যবসার ফড়িয়া বা দালাল, অথবা পারিবারিক পরিচয়সূত্র ধরে, আবার কখনও কমলের বাবা-ঠাকুরদার ঐতিহ্যের খাতিরে।

কেউ কেউ বলতো, ‘আহারে, কী বাড়ির মানুষ আইছে আমাগের বাড়ি সাহায্যের জন্যিতি’। তারা কমল-সুভাষকে ডেকে বাড়ির ভেতর নিয়ে গুড় মুড়ি বা গুড় রুটি খেতে দিতো, আর ওদের বিপদমুক্তির জন্য আল্লাহ্‌র দরবারে ফরিয়াদ জানাতো।
কেউ আবার কিছু না দিয়ে কিছু শক্ত কথা শুনিয়ে দিতো। কখনও আবার কোনো বাড়ি থেকে বলতো, ‘কামাই কইরা খাবার পারো না?’

একদিন তো এক বাড়ির একটি সদ্যোভিন্ন বক্ষের মেয়ে ওদের পেছনে কুকুর লেলিয়ে দিলো! পরে মেয়েটির মা এসে কুকুরটিকে শান্ত করে। সেদিন সুভাষ তো বলেই ফেললো, ‘কী খচড়াদোচা মাগীরে!’ কমল সুভাষকে টানতে টানতে ঐ বাড়ি থেকে বের করে আনে। ওরা শুনতে পেলে কি আর আস্ত রাখতো সেদিন?

আর একদিন ওরা সাইচা এলাকা দিয়ে ঘুরছিলো। একটা বাড়িতে কোথাও কট্‌ কট্‌ করে কিসের যেন শব্দ হচ্ছিলো। ওরা যেই গিয়ে বলেছে, ‘এই যে, সাহায্য দিবেন?’, অমনি বাড়ির ভেতর থেকে বেড়িয়ে এলো দুজন লোক। পরপরই এলো একজন বিশ-বাইশ বছরের মহিলা। ওদের দেখে ঐ মহিলা পুরুষ লোক দুটোকে বললো, ‘অগো বাইন্ধা রাখো। তারপর মিলিটারি খবর দেও। ঐ তো ঐ গ্রামে গুলির শব্দ শোনা যায়। অরা মনে অয় শহরের ইন্দু’। এ কথা বলেই মহিলা তৃপ্তির হাসি হাসলো।
 
লোক দুটো কিছু বলার আগেই কমলরা দ্রুত বেড়িয়ে এলো সে বাড়ি থেকে। তারপর সেই যে দৌড়! এক দৌড়ে ডেরায়সেদিন আর বেশি বাড়ি ঘোরা হয়নি। ঐ গ্রামে আর একবারও যায়নি ওরা।    

[চলবে]

No comments:

Post a Comment