[আগের ১৭টি পর্বের পর]
একদিন বাবার সাথে
কমল গেলো নতুবদিয়া।
গৌরদিয়া থেকে
পাচ-ছ’মাইল
গেলে নগরকান্দা-বোয়ালমারীর
বর্ডার। ওখানকার
মাটিতে পা দিতেই
ছাত্রনেতা শরীফ
আফজাল হোসেন, শাহ
জাফরের কথা মনে
পড়লো কমলের। অল্প
দূরেই গোপালগঞ্জ, বঙ্গবন্ধুর
জন্মস্থান। নতুবদিয়া
বাজারে দেখা মিললো
বন্ধুর কাকা, গুরুদাস
কাকার সাথে। কথা
হলো পবিত্র কাকা
ও বন্ধুর সাথে।
ক’দিন যাবৎ
মামিরা এখানে আছে।
ক’দিন পরেই
নাকি অন্যত্র চলে
যাবে।
কমলের বাবা
সকলের সাথে কথা
বললেন। কথার মাঝে
ফরিদপুর শহরের
নিলটুলী এলাকার
ক’জন স্বর্ণকারের
সাথে দেখা ও
কথা হলো। জানা
গেলো, ফরিদপুর শহরের
কিছু কিছু হিন্দু
শহরে ফিরতে শুরু
করেছে। নাপিত, ধোপা,
চর্মকার, মেথর,
ডোম ও জেলে
সম্প্রদায়। নতুন
এক আদেশে সরকারী
কর্মচারী হিন্দুরাও
জেলেদের মধ্যে
শহরে ঢুকবে। মামাও
নাকি কাজে যোগদানের
কথা ভাবছে।
বাবার মন আনন্দে
নেচে ওঠে। যতটা
জানা গেলো, শহরের
অবস্থা এখন স্বাভাবিক,
তবে মিলিটারিরা ও
বিহারিরা নাকি
গ্রাম অপারেশনের কথা
ভাবছে। গোপালগঞ্জের গ্রামের
মানুষ হিন্দু-মুসলমান
সবাই এখন পর্যন্ত
পবিত্রই আছে।
তবে মিলিটারি আতংক
মাঝে মধ্যে হয়।
কিন্তু অনুন্নত যোগাযোগ
ব্যবস্থার কারণে
ভয় মাঝে মধ্যে
সাহস সঞ্চার করে।
সেদিন সন্ধ্যার পর
ওরা গৌরদিয়া ফিরলো।
সেখানে কেটে গেলো
আরও কিছুদিন।
হঠাৎ করেই এক
সময় গৌরদিয়াবাসীর
মানসিক অধঃপতন ঘটতে
থাকে। মুখে মুখে আসতে থাকে বিভিন্ন এলাকার লুটের খবর। কিন্তু ভুঁইয়াবাড়ির
ব্যাপারে সবারই শ্রদ্ধাবোধ অটুট থাকে। তবে লুটের মাল গৌরদিয়ার ঢুকে অনেকের ভেতরেই
লালসা জাগায়।
ভুঁইয়া দাদু একদিন হঠাৎ কমল আর সুভাষকে ডেকে বললেন, ‘দাদু, এভাবে বসে বসে
খাওয়া ঠিক হচ্ছে না। তোমরা দু’জন বরং ঐ পালানের ধানক্ষেতটা নিড়িয়ে আসো’।
দাদুর অঙুলি নির্দেশ লক্ষ্য করে সুভাষ এক বাক্যে রাজী হয়ে যায়। কমল ভাবে
অন্য কথা, ‘শ্যামল রবিরা থাকতে আমাদের দু’জনকে বললো কেনো?’ আর মুখে বললো, ‘দাদু,
আমরা তো চিনি না কোনটা ধানগাছ আর কোনটা আগাছা’।
দাদু বললেন, ‘যে গাছের পাতা ধার, হুল হুল আর পাতার গোড়ায় মালার মত, সেটা
রেখে বাকিটা তুলে ফেলবে। তারপর দুপুরে, নারকেল গাছ থেকে যত পারো ডাব-নারকেল পেড়ে
খাবে’।
সুভাষের উৎসাহ বেড়ে গেলো। নিড়ানী নিয়ে ওরা ছুটলো পালানে। কড়া রোদে বেশ
কিছুক্ষণ নিড়িয়ে সুভাষের জলের তৃষ্ণা পেলো। কমলও তার পিপাসার কথা জানালো। সুভাষ
পাশের বাড়ির দিকে ছুটলো আর বললো, ‘আমি জল খেয়ে তোর জন্য জগে করে নিয়ে আসি’।
কমল নিড়িয়ে চলে, আর সুভাষকে লক্ষ্য করে। সুভাষ বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে জানালায় কার সাথে যেনো
কথা বললো। কিছুক্ষণ পর জলের জগ আর গ্লাস হাতে ও বাড়ির মেয়ে বিজলী এলো। সুভাষ জল
খেতে খেতে বিজলীকে কী যেন বললো। বিজলীর চোখে বিদ্যুৎ খেলে গেলো। চোখ নামিয়ে অদ্ভুত
মেয়েলি ঢঙে মাথা ঝাকালো। সুভাষের মুখে দুঠুমির হাসি। ও কমলকে একবার দেখে নিয়ে বিজলীর দিকে দু’পা
এগিয়ে গেলো। কমল তখন নিমগ্নচিত্তে নিড়াচ্ছে, এমন ভাব মুখে এনে নিড়ানী চালাতে
থাকলো। দাদার চোরা দৃষ্টি সম্বন্ধে আজ্ঞই থেকে গেলো সুভাষ।
ভুঁইয়া দাদু ধীর পায়ে এগিয়ে আসেন কমলের সামনে। নিড়ানো দেখেন। সহসা চেঁচিয়ে
ওঠেন, ‘করো কি করো কি দাদু! সর্বনাশ করে ফেলেছো! তো, আর এক পণ্ডিত কোথায়?’ কমল
হাতের ইশারায় সুভাষকে দেখায়। দাদু সেদিকে চোখ রাখেন। বলেন, ‘ওহ, এ জন্যই বুঝি নিড়ানোর আগ্রহ ওর বেড়ে
গিয়েছিলো! আমি তো ভেবেছিলাম পণ্ডিতরা আমার কী উপকারটাই না করছে! যাও, যাও আর
নিড়াতে হবে না’।
কমল লজ্জা পায়। বলে, ‘দাদু, এবারে আর ভুল হবে না’।
‘ঠিক আছে। যা ভালো মনে করো, করো। দেখো গরম-টরম লাগিও না আবার’।
দাদু চলে যান। সুভাষ ফিরে আসে। কমল নিড়াতে থাকে। এভাবে কেটে গেলো আরও ক’টি
দিন।
একদিন রাতে আফছার পিসামশাইকে ফিস ফিস করে কী সব যেন বললো। পিসামশাই
চিন্তিত হয়ে পড়লেন। বাবলুদাকে সরিয়ে দেবার ব্যাপারে দাদুর সাথে আলাপ করলেন। বাবা-কাকার
মধ্যে আলোচনাকালে কমল যেটুকু বুঝলো তা হলো, সারুকদিয়ার বোসবাড়ি হামলার প্রস্তুতি
চলছে। কারা নাকি রামদা সুরকি নিয়ে বোসবাড়ি ঘিরে রেখেছে। অধীর বোসকে খুন করার আর
ওবাড়ির মেয়েদের তুলে নিয়ে যাবার ষড়যন্ত্র চলছে। নগরকান্দা, গোট্টী ও আটঘর এলাকার
স্বাধীনতাবিরোধীরা নাকি একজোট হয়েছে।
রাতভর ভুঁইয়াবাড়ির কারো চোখে ঘুম এলো না। ছোটরা ঘুমোয় আর বড়রা তাঁদের সজাগ
করে। রাত তিনটের দিকে বাবলুদাসহ গ্রামের ছেলেমেয়েদের নিয়ে বিশ জনের একটি দল ভারত
অভিমুখে গ্রাম ছাড়লো। কমলের মা ওর বাবাকে অনুরোধ করলেন, যেন কমলকে ওদের সাথে ছেড়ে
দেন। বাবা বললেন, ‘জনপ্রতি একশ করে টাকা দিতে হচ্ছে। আমার তো এক টাকাও নেই। যা
ছিলো তাও তো সেদিন ওরা কেড়ে নিলো’।
কমলের মা আর কথা বাড়ালেন না।
পরদিন সকালেই বোসবাড়ির খবর জানা গেলো। ও বাড়ির সাত-আটটি পরীর মতো
সুন্দরী মেয়ে অভিনব কায়দায় বাড়ি থেকে
বেরিয়ে গেছে। কেউ রাখালের বেশে বদনা হাতে, আবার কেউ প্রতিবেশী মুসলমান ঝি-বউদের
সাথে ওদের শাড়ি পরে ওদের একজন হয়ে কলসী কাঁখে প্রথমে মুসলমানদের বাড়িতে উঠেছে।
তারপর ওদের সহায়তায় রাতারাতি ভারতের পথে গ্রাম ছেড়েছে। আর অধীর বোস পালিয়েছেন
অন্যভাবে। মেয়েরা নিরাপদে সরে যাবার পর বাড়ির লোকেরাই লাঠি-সোটা দা দিয়ে টিনের
বেড়ায় এলোপাথাড়ি আঘাত করে তুলে নেয়। যারা বোসবাড়ি ঘিরে ছিলো, তারা ঐ দিকে জড়ো হলে
বাড়ির অন্য দিক দিয়ে অধীর বোসসহ আরও দু-চারজন পালিয়ে যান। স্বাধীনতাবিরোধীরা নাকি
এখন বোসবাড়ি আগুন দেবার কথা ভাবছে।
দুপুরে আফছার এলো পিসামশাইয়ের
কাছে। বললো, সালথা-গোট্টির লোকজন নাকি সারুকদিয়া গৌরদিয়া লুট করার পায়তারা করছে।
আফছার আরও বললো, ‘সারুকদিয়া ওরা নুট হরে হরুক, গুরদিয়া নুট হরবার দেবোনা। এতি জান
ধরে থাক আর যাক’।
পিসামশাই তাকে বলে, ‘লুট হয় হবে। তুমি এ জন্য মাথা গরম কোরো না আফছার।
তোমরা তো আমাদের জন্য কম করছো না’। কমলের বাবা-কাকাও পিসামশাইর কথায় সায় দেয়।
আফছার বলে, ‘না বাবু, এডা আমাগোর মান-ইজ্জতের ব্যাপার। আমরা থাকতি এ গ্রাম
নুট হরবি সারমা-গোট্টীর মাইনষে? এডা অয় না’।
পরদিন ভোরে গ্রামের চারদিকে চিৎকার-শোরগোল শোনা গেলো। ভুঁইয়া বাড়ির সবাই
দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়লো। শুনতে শুনতে শোনা গেলো, কারা যেন ঐ গ্রাম লুট করতে
আসছে। গৌরদিয়ার মানুষ তাদের ঢুকতে দিচ্ছে না। খাল পাড়ে দু’দলের মধ্যে কাইজ্যা
চলছে।
কমল কোনোদিন কাইজ্যা দেখেনি। ও খুব চঞ্চল হয়ে ওঠে। সুভাষকে নিয়ে ও সেদিকে
ছোটে। গ্রামের নারী-পুরুষ সেদিকে ছোটাছুটি করে। কারো হাতে ঢাল, কারো হাতে বল্লম
কাতরা সড়কি। মাঝবয়সী মহিলারা সেদিকে ছোটে আর হিন্দুদের উদ্দেশ্যে অকথ্য ভাষায়
গালিগালাজ করে। কেউ কেউ ভোটের গুষ্টি মারে। আবার কেউ শেখ মুজিবের উদ্দেশ্যে বকা
দেয়।
ভাব-সাব বেগতিক দেখে কমল আর সুভাষ বোসবাড়ির ধারে একটি আমগাছে উঠে ডালে
গিয়ে বসে আর লোকজনের যাতায়াত দেখে। এক সময় সুভাষকে নিষ্প্রাণ দেখে কমল প্রশ্ন করে,
‘কি রে, তোর ভয় করছে?’
সুভাষ মাথা নড়ায়, ‘না’।
‘তবে?’
‘বিজলীরা চলে গেছে ভারতে’।
‘ও, এই কথা? তাতে তোর কি হয়েছে? যাবে না? প্রাণের মায়া, বড় মায়া। দ্যাখ
আমাদেরই কার কোথায় যেতে হয়!’
এমন সময় দু’জন আহত লোককে ধরাধরি করে নিয়ে যেতে দেখা গেলো। তার বাম পাজরে
রক্তের চিহ্ন। গামছা দিয়ে বাঁধা। লোকটি কাতরাচ্ছে।
[চলবে]
No comments:
Post a Comment