[ আগের ১৬টি পর্বের পর]
বড়পিসিদের বাড়িতে
পৌঁছতেই, বাড়ির
সবাই এসে ভিড়
করে ওদের চারপাশে। বাবার
খোড়া পা’টা
পিসিকে বিচলিত করে। জেঠার
মৃত্যুর খবরে
সবাই আতংকগ্রস্থ ও
ব্যাথিত হয়। প্রতিবেশী
হিন্দু-মুসলমান দুশ্চিন্তাগ্রস্থ
হয়ে পড়ে।
এভাবে তিনটা দিন
ভালোই কেটে গেলো। চতুর্থ
দিন বিহারি-আতংক
গ্রামবাসীকে ভীতির
মধ্যে ফেলে দেয়। শোনা
গেলো গ্রামের কারা
যেন শহরে গেছে
বিহারিদের সাথে
একাত্ম হতে। দু-একদিনের
মধ্যেই নাকি বিহারি
ঢুকবে গ্রামে।
বদরপুর সালমা কাবা
ফিডার রোড। রোডের
পাশেই সোমসপুর গ্রাম। রাস্তা-সংলগ্ন
এই নাগদের বাড়ি। স্বভাবতই
পিসিবাড়ির ওপর
অনেকের লোভ রয়েছে।
পিসিমাদের তিন
শরিকের একান্নবর্তী সংসার। ছেলেপেলে
নিয়ে ত্রিশ জনের
জমজমাট পরিবার। রয়েছে
বাৎসরিক রাখাল। আর
আছে পিসিমার বিধবা
ননদ এবং কমলদের
পরিবার। পিসামশাই
ও তাঁর ভাইয়েরা
সবাই উদ্বিগ্ন। ছোটপিসা
(ছোট ফুপা) গ্রামের
গণ্যমান্যদের ডেকে
পাঠান। তারা
এলে নিজেদের তত্ত্বাবধানেই
নিজেদের মালামাল
লুট করিয়ে দেওয়া
হয়, যাতে বাইরের
কেউ লুট করতে
না পারে। মাতুব্বরদের
সামনে নাগবাড়ির মালামাল
গ্রামবাসীর মধ্যে
দিয়ে দিলে প্রয়োজনমত
সংসারের চাহিদা
মিটবে, আর সময়
হলে ফেরত পাওয়ার
সম্ভাবনা থাকবে।
সন্ধ্যার পরপর
মাতব্বররা নাগবাড়িতে
উপস্থিত হলেন। আলোচনা
শেষে মালামাল গ্রামবাসীর
বাড়িতে সরানোর ব্যবস্থা
হলো। কিন্তু
বিহারিদের আতংকে
বড়বৌদি যে সোনার
টোপলা ঘরের পেছনে
হাড়িতে করে পুতে
রেখেছিল, তা
আর যথাস্থানে পাওয়া
গেলো না। বৌদিকে
সবাই গালমন্দ করলো।
শেষ পর্যন্ত রাগের
রেশ গিয়ে পড়লো
কমলদের ওপর। মাতুব্বররা
নাগদের দায়-দায়িত্ব
নিতে রাজি হলেও
কোনো বহিরাগতের দায়িত্ব
নিতে অস্বীকৃতি জানালো। বড়পিসি
আপত্তি করলো, ‘ওরা
এখন যাবে কোথায়?
তাছাড়া ওদের সাথে
তো এমন কোনো
কিছু নেই, যা
নিয়ে ভয়ের কারণ
হতে পারে! এ
নিয়ে মাতুব্বরদের ভেতর
দুটি পক্ষ তৈরি
হলো। এক
পক্ষ কমলদের এখানে
থাকতে দিতে রাজি
নয়। অন্য
পক্ষ বলছে, ‘কালীপদ
তো ছোটবেলা থেকাই
নাগবাড়ি আসে
যায়, সে তো
আমাদের আপনজনের মতো’। কিন্তু
প্রথম পক্ষ যুক্তি
দেখায়, ‘কালীপদর কলেজপড়ুয়া
শহুরে ছেলে। কী
জানি রাজনীতি-ফাজনীতির
সাথে জড়িত কিনা!
বিহারিরা যদি
ওকে চিনতে পেরে
আবার কোনো বিপদ
ঘটায়? তাহলে তা
থেকে গ্রামবাসীরও রক্ষা
নেই’।
শেষ পর্যন্ত পরের
দিন ভোরেই নাগবাড়ি
ছাড়তে হয় কমলদের। পরবর্তী
গন্তব্য ভাবুকদিয়া
মেঝপিসির বাড়ি। সোমসপুর
থেকে দক্ষিণে সাত
মাইলের রাস্তা।
ভাবুকদিয়া পৌঁছে
ঘটলো সোমসপুরের ঘটনারই
পুনরাবৃত্তি। মেঝপিসিসহ
বাড়ির সকল শরীকই
তুলাগ্রামের হত্যাকাণ্ডের
খবর শুনে স্তব্ধ
হয়ে গেলো। তবে
বিহারি আতংক এখানে
এখনও আসেনি। তাছাড়া
গ্রামবাসীরা এখনও
অতটা ধুরন্দর হতে
সাহস করেনি। ওবায়দুর
রহমানের এলাকা। এখানকার
মানুষ বেশিরভাগই মনে
প্রাণে এখনও আওয়ামী
লীগ রয়ে গেছে।
কমলরা ভাবুকদিয়া এসে
দেখলো, ওর কাকাদের
পরিবার সরাসরি এখানেই
চলে এসেছে। বাবা-কাকা,
মা-কাকিমা, টাকু-অঞ্জনা,
কমল-সুভাষসহ দুটি
পরিবারের ভাইবোনদের
সাথে সাধনা-ভজনা,
মন্টুরা একাত্ম
হয়ে গেলো। এখানে
এসে কমলের মনে
কিছুটা প্রাণের সঞ্চার
হলো।
দুপুরে খিচুড়ির আয়োজন
হলো। সাথে ইলিশ।
পিসামশাই বললেন,
‘মরতেই যদি হয়,
তবে খেয়েদেয়েই মরি।
আত্মীয়-স্বজনরা তো
সহজে এদিকে আসে
না, তবু বিপদের
কারণে এগো একটু
খায়-খাতির করার
সুযোগ যহন আইছে,
করতে থাকি’।
দিন দশেক এভাবে
চললো। তারপর আর
এ গ্রাম সে
গ্রাম রইলো না।
শহর ও শহরসংলগ্ন
গ্রামের মানুষদের
মতো এখানকার মানুষও
হিংস্র হয়ে উঠলো।
উঠলো তো উঠলো,
একেবারে তুলাগ্রাম-সোমসপুরকেও
ছাড়িয়ে গেলো। কেউ
কেউ নিজেরাই যেন
বিহারি হয়ে দাঁড়াল!
পিসামশাইও আর
পিসামশাই রইলেন
না। ভুলে গেলেন
অতিথিসেবার কথা।
তিনি প্রতিবেশী ও
গ্রামবাসীর সাথে
তাল মিলিয়ে কমলদের
দুটো পরিবারের সাথে
অস্বাভাবিক আচরণ
করতে লাগলেন। চালের
খিচুড়ির স্থলে
উঠে এলো গমের
খিচুড়ি। আটা
ভাঙা গম, আস্ত
ছোলার ডাল, সাথে
আস্ত আস্ত পিঁয়াজ।
তাও খেতে ছিলো
খুব মজার।
মা-বাবাকে আর
কাকিমা-কাকাকে বিষয়টির
প্রতি ইঙ্গিত করেও
কোনো ফল পায়
না কমল। বাবা
পিসামশাইয়ের হুকো
গড়গড় করে টানে
আর ভাবে। কাকাও
বাবার দিকে পিঠ
করে তাঁকে সম্মান
করে গড়গড়িয়ে হুকো
খায়। কাকিমা মায়ের
ওপর নিজেকে সঁপে
দেয়। মা মুরুব্বির
মতো হাত-পা
গুটিয়ে বসে থাকে,
আবার পিসির কাছে
ছুটে যায়--
‘ঠাকুরমা, এ
বিপদের দিনে তোমরা
আমাদের তাড়িয়ে দিও
না ভাই!’ পিসি
নিরুপায়। নীরবে-নিভৃতে
শুধু চোখের জল
ফেলে।
বাবা-কাকা হুক্কার
কাছে থেকে সরে
গেলে সুভাষ কমলকে
নিয়ে হুক্কার কাছে
যায়। কমলের হাঁটুর
উপর দুই হাত
চেপে অনুরোধের সুরে
সুভাষ বলে, ‘দাদা,
তোর পায়ে ধরি।
কারো কাছে কইস
না’।
কমল চিন্তিত হয়ে
পা সরিয়ে নেয়।
সুভাষ হুকো হাতে
নিয়ে গড় গড়
শব্দে লুকিয়ে লুকিয়ে
টানে। কমল বিস্মিত
হয়, ‘কি রে
সুভাষ, তুই হুক্কা
খাস?’
‘দাদা, কি
করবো ক? এখানে
সিগারেট পাওয়া
যায় না’।
‘তুই সিগারেট
খাস?’
এমন সময় ছোটবোন
অঞ্জনা আসে। কবরীর
মতো এক গাল
হাসি হেসে কমলের
দিকে চোখ ঘুরিয়ে
বলে, ‘সবাইরে কইয়া
দেবো’।
সুভাষ ওকে ধমক
দেয়। অঞ্জনা দৌড়ে
পালায়। সুভাষ হুক্কায়
টান দিয়েই চলে।
কমল ওকে কিছু
বলে না। এ
মুহূর্তে সুভাষের
সঙ্গ ওর খুব
ভালো লাগে।
কাকার বড় ছেলে
সুভাষ। বয়সে কমলের
এক বছরের ছোট।
লেখাপড়ায় অনেক
পিছিয়ে। লম্বা-চওড়া,
চেহারায় কমলের
চাইতে উন্নত। এই
দুঃসময়ে সমব্যাথী
সুভাষ ওর বন্ধুর
মতো পাশে পাশে
থাকে, এটা কমলের
একান্ত ইচ্ছা। তাই
ওর কাজে বাধা
দেয় না।
সুভাষ গড় গড়
করে হুক্কা টানে।
আত্মতৃপ্তির শ্বাস
ফেলে। ওদিকে, তিন
বেলার খাবার আজকাল
দু’বেলায় নামে।
বেলা এগারোটায় খোসা
ছাড়ানো গমের সাথে
ছোলার ডাল পিঁয়াজের
খিচুড়ী, রাতে কিছু
চাল যোগ হয়
তাতে। সন্ধ্যার সাথে
সাথেই খেয়েদেয়ে ভোরের
অপেক্ষায় লম্বা
ঘুম।
মাঝে মাঝে বড়দিয়া
বাজারে গম ভাঙানোর
জন্য ওদের পাঠানো
হয়। কমল, সুভাষ
ও ভজন প্রত্যেকের
মাথায় থাকে দশ
সেরের বস্তা। চার-পাঁচ
মাইল রোদের পথ
পায়ে হেঁটে বড়দিয়া
বাজার থেকে গম
ভাঙিয়ে আনতে কোনো
কোনোদিন রাত
হয়ে যায়। দুপুরে
সুভাষের পয়সায়
এক হাড়ি তালের
রস চার আনায়
কিনে ওরা তিনজন
খেয়ে খিদে মিটায়।
সুভাষের কোমরে
ওঠে বিড়ির প্যাকেট।
এভাবেও চলে না
আর একটা সময়। একদিন
পিসামশাই তার
ভাইদের পরামর্শে কমলদের একরকম
তাড়িয়েই দেন। উপয়ান্তর
না দেখে বাবা
কাকার সাথে মত
বিনিময় করে গৌরদিয়া
ছোটপিসির ওখানে
যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন।
ভোর হতেই দুটি
পরিবারের একুশ
জনের দলটি রওয়ানা
হলো গৌরদিয়ার উদ্দেশ্যে।
গৌরদিয়া পৌঁছে
দেখা হলো সবার
সাথে। তুলাগ্রামের হত্যাকান্ড
এখন এখানে বিস্মৃতপ্রায়
ঘটনা। কোনো চমক
নেই তাতে। বাবার
পায়ের অবস্থাও ভালো।
তবে এতো বড়
পরিবারের আগমন
দেখে এ বাড়ির
সবাই একটু দম
খেলো। কিন্তু অসৌজন্যমূলক
কিছু দেখালো না।
শত হোক আত্মীয়
তো, নিতান্ত দায়ে
পড়েই না আসা!
নইলে খবরের পর
খবর দিয়ে যাদের
এ-মুখো করতে
পারেনি, তারা নিশ্চয়ই
গায়ে পড়েই এসেছে।
কমলের বাবা ধরতে
গেলে এ বাড়ির
জামাই। ভুঁইয়া মহাশয়ের
আপন ভাগ্নী বিয়ে
দিয়েছিলো বাবার
সাথে। তার মৃত্যুর
পর ভুঁইয়া মহাশয়ের
শ্যালকদের সাথে
বিয়ে হয় ছোট
পিসির। তাছাড়া পিসামশাই
নানা স্থানে ঘুরে
ঘুরে তহশীলদারের চাকরি
করেন। এ যাবৎ
কমলের বাবা-মা
নানাভাবে তাদের
উপকার করেছেন। বড়
ছেলে বাবলুর স্কুলের
ভাত রেঁধে দেওয়া,
অভিভাবকত্ব করা,
মোকাদ্দমার সময়
আট-দশজনের ভাত
রেঁধে খাইয়ে কাচারী
করার সুযোগ করে
দেওয়া, পিসামশাইয়ের ফরিদপুরে
বাড়ি তৈরি ও
দেখাশুনা ইত্যাদি
কারণে মনে যা-ই
থাক, মুখে কিছু
বলার সুযোগ তাদের
ঘটেনি। আর এটাই
কমলদের বর্তমান অবস্থার
জন্য সহায়ক।
ক’দিন ভালোই
কাটলো এখানে। খাদ্যখানা
বলতে আটার রুটি,
গম অথবা চালের
খিচুরী, সফেন ভাত,
পাটশাক। কোনোদিন
পুকুরের মাছ।
কমলদের খাদ্যের যোগান
আসতে থাকে এ-বাড়ি
ও-বাড়ি থেকে।
রায়বাড়ি, পালবাড়ি,
দাসবাড়ি, দত্তবাড়িতে
গিয়ে কমলের বাবা-কাকা
গল্পগুজব করেন
আর আসবার সময়
আজ পাঁচ সের
চাল তো কাল
পাঁচ সের আটা
গম অথবা এটা-ওটা
হাতে নিয়ে ফেরেন।
ওদের কথা হলো,
যদি লুটপাট হয়ে
যায়, তবে তো
বারোজনে লুটে
নেবে। তার চেয়ে
স্বজাতি-জ্ঞাতিরা
খেয়ে বাঁচুক। এ
জন্য পিসামশাইর বড়
সংসারে কমলরা আর
বোঝা হয়ে রইলো
না। তবু তেলটা
লবণটা কেরোসিনটা তো
পিসিদেরই দিতে
হচ্ছে!
পিসির ছেলে বাবলুদা,
রবি, শ্যামল, কাকার
ছেলে সুভাষ, গনেশ
আর কমল, সবাই
মিলেমিশে হেসেখেলে
কেটে গেলো বেশ
কিছুদিন। বাবা,
কাকা, দাস মশাই,
ভুঁইয়া দাদু, প্রতিবেশী
আরও অনেকে এসে
পিসামশাইয়ের সাথে
দেশের অবস্থা নিয়ে
আলাপ করেন। পিসামশাই
তহশীলদার মানুষ,
নানা জায়গা ঘুরে
চাকরি করেছেন, তার
অভিজ্ঞতার মূল্য
সকলেই দেয়। মাঝে
মধ্যে তার পিওন
আফছার এসে শহরের
খোঁজখবর দেয়,
অভয় দেয়—‘বাবু,
আমি বাঁচা থাকতে
আপনাগোর কোনো
ক্ষতি কেউ করবার
পারবি না’।
পিসামশাইর ধারণাও তাই। এ তল্লাটে ভাই-ভাতিজা দিয়ে আফসারের পরিবারই বড়। দু-একটা কাইজা ঠেকানোর মতো জনবল, সাহস ওদের আছে। আফছার কমলের মা-বাবাকেও সম্মান দেখায়। পিসামশাইর এ-খবর সে-খবর নিয়ে আফছার ফরিদপুরে কমলদের বাড়িতেই উঠতো। মা-বাবা ওকে খুব সমাদর করতেন। সে কথাও সে ভোলেনি। এই বিপদে এটাও বোধ করি রক্ষা পাওয়ার একটি উপায়।
[চলবে]
No comments:
Post a Comment