[আগের ১৫টি পর্বের পর]
কমলের দিদিমা মামি
মামারা সবাই তখন
পিয়ারপুরের অনু
ঠাকুরের বাড়িতে। কমলের
মেঝ ভাই শিবুও
তাদের সাথে। যা
দিনকাল, স্বভাবতই মায়ের
মন কোনো না
কোনো দুঃসংবাদের অপেক্ষাতেই
থাকে। কমল
মাকে আশ্বস্ত করে,
আগামীকাল ভোরে
পিয়ারপুর থেকে
ওদের সংবাদ এনে
দেবে বলে।
এক সময় সিদ্ধান্ত
হলো, কাল ভোরেই
সবাই এখান থেকে
সরে যাবে। থাকবে
শুধু ঠাকুমা আর
বিষুদার বিকলাঙ্গ
ভাইটি। কমলরা
যাবে সোমসপুরে ওর
বড়পিসির ওখানে,
আর ওর জ্যাঠাতো
ভাই বিষুদারা যাবে
সুলতানপুর বড়বোনের
বাড়ি।
পরদিন ভোরে সাইকেল
যোগে কমল পিয়ারপুরের
উদ্দেশ্যে ছোটে। সাতটার
মধ্যেই দিদিমার খবর
এনে মাকে চিন্তামুক্ত
করলো। তাদের
কোনো ক্ষতি হয়নি,
তবে সর্বস্ব লুট
হয়ে গেছে। অনু
ঠাকুরের বাড়িতে
কারা যেন আগুন
দিতে গিয়েছিলো। কিন্তু
এলাকাবাসীর হস্তক্ষেপে
তা রক্ষা পেয়েছে। অনু
ঠাকুর পিরিচিত লোকদের
মধ্যে মালামাল সরিয়ে
দিয়েছেন। এর
মধ্যে কিছু হাতছাড়া
হয়ে গেছে। এ
পর্যন্ত বিশ-বাইশ
জনের প্রাণহানির খবর
পাওয়া গেছে। আহত
হয়েছে অনেক। অনু
ঠাকুরের বাড়ির
পাশেই লাশ হয়েছে
১০-১২ জন।
অনু ঠাকুরের বাড়িতে
দিদিমার একটি
অভিজ্ঞতা কমলকে
নাড়া দিয়ে গেলো--
হাড়োকান্দির লোকন
দিদিমাদের বাসায়
মাসকাবারি দুধ
দিত। দাদুর
ছাত্র বলে নির্ভেজাল
দুধ দিত সে। তাছাড়া
শিক্ষক পরিবারের প্রতি
তার কর্তব্যের কমতি
ছিল না। অথচ
সেও এসেছিল লুটেরাদের
সাথে লুট করতে!
দিদিমাকে অনু
ঠাকুরের বাড়িতে
দেখেই চমকে ওঠে
সে। অপরাধীর
মতো চুপসে যায়। তারপর
ধীর পায়ে ফিরে
যেতে উদ্যত হয়। দিদিমা
ওকে সঙ্কোচ থেকে
নিবৃত্ত করেন। বলেন,
‘লোকন, এটা কোনো
অপরাধ না। সবার
সাথে তুমি না
এলে হয়তো অন্যরা
তোমাকে বিপদে ফেলতো। তুমি
এসে বরং ভালোই
হয়েছে। তুমি
আমার মালামাল নিয়ে
যাও। আমি
এসব তোমাকে দিচ্ছি’।
লোকন পাথরের মতো
দাঁড়িয়ে রইল। দ্বিধা,
সঙ্কোচ আর অপরাধবোধ
ওকে বল্লমের মতো
খোঁচাতে লাগলো। দিদিমা
বললেন, ‘আচ্ছা, এখন
তুমি এগুলো নিয়ে
যাও। যদি
প্রাণে বেঁচে থাকি
আর দেশ যদি
শান্ত হয়, তখন
না হয় আমাকে
ফিরিয়ে দিও’।
দিদিমার এ
কথায় রাজি হয়
লোকন। ফিরিয়ে
দেবার প্রতিশ্রুতিতে
দিদিমার বিশেষ
বিশেষ জিনিষপত্র নিয়ে
যায় সে।
দিদিমারাও সকালের
মধ্যেই পিয়ারপুর ত্যাগ
করবে বলে জেনেছে
কমল। ও
গ্রামে হিন্দুপল্লীর
কেউই আর থাকতে
সাহস পাচ্ছে না।
ন’টার মধ্যেই
কমলরা ঘর ছাড়লো
সোমসপুরের উদ্দেশ্যে,
আর বিশুদারা সুলতানপুর। সে
কী হৃদয়বিদারক দৃশ্য!
কমলরা পরিবার-পরিজন
নিয়ে দ্বিতীয়বারের
মতো ঘর ছাড়লেও,
ওদের চাইতে বিশুদাদের
ঘর ছাড়ার বিষয়টিই
বেশি মর্মস্পর্শী। কারণ
তারা পরিবারের অভিভাবক
হারিয়ে এতিম হয়ে
এক পাজা কষ্ট-বেদনা
নিয়ে ঘর ছাড়ছে। দিদির
বাড়ির যাত্রাও তাদের
কাছে অনিশ্চিত। বুধ
থেকে শনি, মাত্র
তিনদিনের ব্যবধানে
একটি তরতাজা প্রাণ
হারিয়ে চলছে বিশুদার
পরিবার। সামনে
আরও যে কী
আছে ভাগ্য, কে
জানে?
বিশুদারা এগিয়ে
যায়। এগিয়ে
যায় কমলরাও। কিছু
দূর গিয়ে দু’দিকে
মোড় নেয় দুটি
অসম পরিবার। কমলরা
এগোয় দক্ষিণে। চলায়
নেই কোনো প্রাণের
স্পন্দন। শ্লথ,
মন্থর গতি; বুধবারের
মতো বোচকার বহরও
এখন নেই। ফরিদপুর
থেকে যা এসেছিলো,
তাও গতকাল লুট
হয়ে গেছে। শুধু
কমলের বইয়ের বাক্স,
আর যে যা
হাতে-সাথে করে
নিয়ে পালিয়েছিলো, তাই
এখন সম্বল। পরনের
কাপড় ছাড়া কোনো
বাড়তি কাপড়-চোপড়ও
নেই। নেই
চাল-আটার ব্যাগও।
ওরা হাঁটে। এই মূহূর্তে সোমসপুর যেন অনেক দূর বলে মনে হয়। পাঁচ মাইলের সোমসপুরের পথ এখন মনে হয় পঁচিশ মাইল...
[চলবে]
No comments:
Post a Comment