খুঁজুন

Tuesday, April 25, 2017

মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাসঃ কমলের একাত্তর / বাবু ফরিদী [ অংশ ২১]




[পূর্বপ্রকাশিত ২০টি পর্বের পর] 

নানা স্মৃতি নানা কথা মাথার মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে রাতে কমলের ঘুম এলো না। ভোরে বিছানা ছেড়ে হাত-মুখ ধুতেই ওর কাকা বললো, ‘চলো কাকু, আজ আমরা দুজন মঙ্গলকোট যাই। দেখি ওখান থেকে কিছু আনতে পারি কিনা’। 

কমল রাজী হলো। কাকা তৈরি হয়ে নিলো।

কাকা মঙ্গলকোট গ্রামে ঢুকে সোজা সফি পরামানিকের বাড়ি উঠলো। উনি একজন আওয়ামী লীগ কর্মী। খোঁজ নিয়ে জানা গেলো, সফি সাহেব বাড়ি ছেড়েছেন আজ তিনমাস। বাড়িতে দিনের বেলা শুধু মেয়ে মানুষ আর কমবয়েসী পুরুষরা থাকে। রাতে পুরুষলোকেরা আসে, আবার ভোর হতেই সরে যায় অন্য কোনোখানে।

বাড়ির লোক কাকার পরিচয় পেতেই কমলদের বসতে দিলো। সফি সাহেব কাকার ময়রাপট্টির দোকান ঘরটি কিনেছেন তিন বছর ধরে। তাছাড়া কাকাদের সাথে ব্যবসায়ও অংশীদারিত্ব আছে। আসা-যাওয়া, ওঠা-বসায় কাকা ওদের খুব কাছের মানুষ জেনে এবং কাকার মুখ থেকে নানান রকম দুঃখ কষ্ট ও বঞ্চনার কথা শুনে বর্ষীয়ান মহিলারা অশ্রু বিসর্জন দিলেন। তারপর পুকুর থেকে মাছ ধরালেন, উনুনে চড়ালেন ভাত।

গল্পে গল্পে এক সময় রান্না শেষ হলো। কমলরা খেতে বসলো। লাল লাল দেশী চাউলের ভাত, মাছের ঝোল। ঈশ্‌, কী মজাটাই না হলো খেতে বসে! এই তিনমাস ভাত ওদের ভাগ্যে জোটেনি। খোসা ছাড়ানো গমের সাথে কিছু চাউল মিশতো ঠিকই, কিন্তু তা খিচুরীতে গিয়ে গমের পাশে অস্তিত্বহীন হয়ে যেত।

খাওয়া শেষে লবণে আটকে যাওয়া এবং মাটিতে পড়ে থাকা কিছু ভাত সবার অলক্ষ্যে তুলে ধুয়ে মুখে পুরলো কমল। কাকাও খাওয়া শেষে তৃপ্তির শ্বাস ফেললেন। মুখে দিলেন পান। টানলেন হুকো।

উঠবার সময় সফি সাহেবের মা কাকার হাতে তুলে দিলেন একটি চালের পোটলা।
ক’দিন যেতেই বেতবাড়িয়ার ভাবও খারাপ হয়ে গেলো। ছোটখাটো দু’চার ঘর হিন্দু যা ছিলো তাদের অনেকেই দেশ ছেড়ে চলে গেছে। যারা আছে তারাও পরাস্ত, যাবার পায়তারা করছে। চিত্তবাবু বাড়িঘর জমা রেখে দেশ ছাড়তে চায় না। এতদিনের তিলতিল করে গড়ে তোলা সংসার, বাবা-দাদার ভিটেমাটি ছেড়ে যেতে কি মন যায়? 

গ্রামের মানুষও তাঁকে গ্রামেই রাখতে চায়। কিন্তু মুশকিল বাধিয়েছে দু’চারজন টাউট। গ্রামের মানুষ সংঘবদ্ধভাবে তাদের প্রতিরোধ করতে গিয়ে নিজেরাই বিপদে জড়িয়ে যাচ্ছে। শোনা গেলো, টাউটরা নাকি শহরে যোগাযোগ করে বিহারি ভাড়া আনার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।

প্রতি রাতে রায় বাড়িতে মিটিং বসে। কী করা যায় এ নিয়ে চিত্তবাবু কাছের মানুষদের সাথে মত বিনিময় হয়। গ্রামের মাতুব্বর ও মুরুব্বিরা আসে, আড্ডা দেয়, পান-তামাক শেষে বিদায়। এক্ষেত্রে কমলদের পরিবার থাকে নীরব শ্রোতা। ওরা বিদেশী, আজ আছে কাল নেই, চাল আছে চুলো নেই অবস্থা। এ অবস্থায় ওদের পরামর্শ-উপদেশ দেবার বা নেবার প্রয়োজন কেউ মনে করে না।

এরই মধ্যে কাকার কাছে একটি চমৎকার খবর এলো। খবরটি কাকাকেও আকৃষ্ট করলো। খলিলপুর কাকার ভায়রাবাড়িতে কিছুদিন আগে বিহারিরা স্থানীয় লোকদের সহায়তায় অপারেশনে যায়। তারা বাড়ির পুরুষদের ধরে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে গুলি করতে যাবে, এমন সময় ঘরের ভেতর থেকে ছুটে আসে একজন বিহারি। হাতে তার রাইফেলের পাশাপাশি একটি ছবি। ছবিটি দেখিয়ে বাড়ির পুরুষদের কাছে তাদের পরিচয় জানতে চায় সে। সাহসের উপর ভর করে তারা জানায় ছবির ঐ লোকটি আমাদের আত্মীয়। কাকার ভায়রা সগর্বে বলে উঠে, ‘উনি আমার বদ্রীর দুলাভাই’। 

সঙ্গে সঙ্গে সকল বিহারির মধ্যে কথোপকথন হয়। তাক করা রাইফেলের নল নেমে আসে। কারণ হিসেবে জানা গেলো, আলীমুজ্জামান সেতুর গোড়ায় বাসা সংলগ্ন কাকার যে লন্ড্রিটি ছিলো, সেখানে ওরা কাকাকে দেখেছে। ওদের ধারণা কাকা পেশায় ধোপা। আর ধোপার আত্মীয় হিসেবে এরাও ধোপা। ধোপা নাপিত জেলে—এদের হত্যা করা এখন বেআইনী। কাজেই, বেঁচে যায় তারা।

এ খবরে কাকার মনে শহরে ফেরার স্পৃহা বেড়ে যায়। মনে মনে পরিকল্পনা আঁটে বেতবাড়িয়ার পরিবেশ ঘোলাটে হবার আগেই তারা খলিলপুর গিয়ে উঠবে। সেখান থেকে খোঁজ খবর নিয়ে সোজা শহরে গিয়ে লন্ড্রী খুলে বসবে।

কমল ভাবে অন্য কথা। সে মুহূর্তে ওর ছোট পিসামশাইর কথা মনে পড়ে। কাকা তার বাসায় লন্ড্রী আর দশ আনা- ছয় আনা ভাগে সেলুন দিয়েছিলেন বলে পিসামশাই কাকাকে বলেছিলেন, ‘কায়স্থ-কুলিন ঘরের ছেলে শেষ পর্যন্ত ব্যবসা আর পেলো না! একেবারে ধোপা-নাপিত? জাত-পাত আর রাখবে না এরা। এদের সাথে সম্পর্ক রাখাটাও এখন পাপের’।

কমল ভাবে, নিয়তির কী খেলা, আজ ধোপা পরিচয়েই কতগুলো মানুষের জীবন রক্ষা পেলো!

চৈতবাড়িয়া সংকটে কাকার জন্য একটা পথ খোলা থাকলেও বাবার জন্য কাকা চিন্তিত। বাবাও বিচলিত। কাকার সাথে খলিলপুর যাবার প্রস্তাবে বাবা অমত করেন।
একদিন বাবা কমলকে নিয়ে তুলাগ্রামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন। কবিরপুরের শেষ মাথায় বাবার এক পুরানো বন্ধুর বাড়ির খোঁজ করতে করতে পেয়ে গেলেন। জানা গেলো, বাবার সে বন্ধু তিন বছর হলো মারা গেছে। তার অন্ধ বৃদ্ধা মা-বাবার পরিচয় পেয়ে কিছুক্ষণ ছেলের শোকে কাঁদলেন। তারপর বাবার সাথে গল্পে গল্পে সময় কাটালেন। সেই ফাঁকে ছেলে-বৌকে দিয়ে ভাত রাধালেন এবং খেতে দিলেন।

কমলের বাবা শুধু এক গ্লাস জল খেলেন। কমল ভাত খেতে লাগলো। বৃদ্ধা বাবার সাথে কথা বলার ফাঁকে কমলের মাথা মুখমন্ডল হাতিয়ে দেখতে লাগলেন কমল ভাত মুখে দিচ্ছে কিনা, অর্থাৎ খাচ্ছে কি না। এমন আদরমাখানো পরশ এ তিন-মাসে কমল কারো কাছ থেকে পায়নি বিধায় অশ্রু আর ধরে রাখতে পারলো না। কমলের চোখের কোণে অশ্রু অনুভব করে বৃদ্ধাও কেঁদে ফেললেন।

খাওয়া শেষে বৃদ্ধার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তুলগ্রাম ঢুকে বাবার যেন সৌভাগ্যের চাবি মিললো। গ্রামবাসী তিনমাস যাবৎ একজন ডাক্তারের অভাব বোধ করছিলো। বলাই ডাক্তারকে মেরে ফেলার পর অনভিজ্ঞ সোনা ডাক্তার গ্রামবাসীর চিকিৎসা করছিলো। কিন্তু সে কুলিয়ে উঠতে পারছিলো না। গ্রামবাসী অনুরোধ করলো বাবা যেন তাদের গাঁয়ে ফিরে আসেন এবং প্রাকটিস শুরু করেন। বাবা তাদের কথা দিয়ে এলেন। কমল লক্ষ্য করলো, শহরের কাছাকাছি গ্রামগুলোই এখন বেশী শান্ত ও শান্তিময়।

বেতবাড়িয়া ফিরতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। রায়বাড়ির উঠোনে পা রাখতেই দেখলো, রায়মশাই ক’জন মানুষের সাথে কথা বলছে। তারা যেভাবেই হোক গ্রামে রাখতে চায় চিত্ত রায়কে। কিন্তু কিভাবে? 

এসময় প্রস্তাব এলো, চিত্ত রায় মুসলমান হলে আর কোনো অসুবিধা হবে না। চিত্ত রায় কিছুক্ষণ কোনো জবাব দিলো না। তারপর বললো, ‘আমারে কয়টা দিন সময় দেন। আমি একটু ভাবি’। 

[চলবে]

Monday, April 24, 2017

মুক্তিযুদ্ধের চাক্ষুষ ঘটনা নিয়ে বাবু ফরিদীর উপন্যাস 'কমলের একাত্তর' [পার্ট ২০]





[আগের ১৯টি পর্বের পর]
একদিন বিছানায় শুয়ে কমলের ঘুম এলো না। মিনির জন্য মনটা যেন কেমন করলো। আগেও অনেকবার মিনির কথা মনে হয়েছে, কিন্তু নানা প্রতিকূলতা ও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় তা মিলিয়ে গেছে। মনে মনে মিনির জন্য ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেছে, ওরা যেন ভালো থাকে। অথচ আজ মিনি কিছুতেই ওকে ছাড়ছে না। মনে হয় বিছানায় পাশেই মিনি। ওর নিঃশ্বাস যেন সেই দুর্গা মন্ডপের অনুভএখন, এই অসময়ে ও কমলের সমস্ত মন-প্রাণ উদ্দীপিত করে। মনে হয় মিনির অশরীরী আত্মা ওকে ঘিরেই আবর্তিত হচ্ছে যেন। কমল চিন্তিত হয়। তবে কি মিনির কোনো বিপদ? মিনি কি তাহলে...

আর ভাবতে চায় না কমল। মিনি ওকে যতই বিরক্ত করুক, কমল ওকে ভুলে থাকবে। মিনিরা ভালো আছে এ ধারণা নিয়েই ভুলে থাকবে। এ মুহূর্তে সাহসের উপর ভর করেই চলতে চায় ও। মৃত্যু যদি আসে তো হঠাৎ করেই আসুক। দুশ্চিন্তার মধ্যে উদ্বেগের মধ্যে সময় কাটালে মৃত্যুর আগেই তো মৃত্যু হয়ে যায়। নিজের কিংবা অন্য কারো মৃত্যুর ভয় বা সংবাদে এখন ওআর টলতে চায় না। হাজার হাজার মানুষ যেখানে হত্যা হচ্ছে, লক্ষ লক্ষ ঘরবাড়ি যেখানে লুটপাট –অগ্নিসংযোগ হচ্ছে, সেখানে কোনো হত্যা-লুণ্ঠন অগ্নিসংযোগ শুধু আভিধানিক অর্থের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। 

তবুও মিনির কোনো দুঃসংবাদ কমলের কাছে নিজের মৃত্যুর মতোই শীতল।
কমল বিছানায় কিছুক্ষণ ছটফট করলো। তারপর নিজের থেকেই চিন্তা ঘুরিয়ে নিলো অন্যদিকে। একেবারে দোরগোড়ার বাস্তবতায়। আড়াই মাস দ্বারে দ্বারে ঘুরে চেয়ে-চিন্তে, আবার স্মৃতিময় বাস্তবতায়। কিছু কিছু ঘটনা ওর মনের আয়নায় ভেসে ওঠে, যা শুকতারার মতো জ্বলজ্বলে হয়ে থাকবে ওর জীবনে। যেদিন দেশ সত্যি সত্যি স্বাধীন হবে, সেদিন থেকে এসব দুঃখ-দুর্দশার স্মৃতিময় অতীত পাহারা দেবে গদিনশীলরাজন্যের, যাতে বসন্তের কোকিলরা কোনোক্রমেই যুক্তবৃক্ষে বসে মিষ্টি মিষ্টি ডাকের আবেশে উতলা না করতে পারে স্বাধীনতাপ্রিয় মানুষকে।

সুভাষ বরাবরই একটু লাজুক স্বভাবের। আর একটু বিলাসপ্রিয় মানুষ। চেয়ে-চিন্তে খাওয়া বা চাওয়ার মতো মানসিকতা ওর নেই। যেখানে বাড়ির বড় ছেলে হিসাবে স্বচ্ছল পরিবারে না চাইতেই অনেক পেয়েছে, সেখানে শত কষ্টেও মুখ ফুটে কিছু চাওয়া ওর জন্যে ছিলো কঠিন কাজ। এ কাজটি করানোর জন্য অনেকদিন অপেক্ষা করতে হয়েছে কমলদের। কমলও যে চেয়ে-চিন্তে খাওয়ায় অভ্যস্ত, তা নয়। তবে কমল বাস্তববাদী। তাইতো সুভাষকে বাস্তবের মুখোমুখি দাঁড় করাতে সময় লেগেছে ওর। যেন সুভাষ অকপটে বলতে পারে, ‘এই যে, কিছু সাহায্য দেবেন?’ কমল তো একমাস যেতে না যেতেই একেবারে ঘুমের মধ্যেও বলে বসতো, ‘এই যে, কিছু সাহায্য দেবেন?’

প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে হাত-মুখ ধুয়ে ওরা সোজা ছুটতো বেতবাড়িয়া থেকে পূবে। তারপর প্রকান্ড বটগাছটা থেকে এক একদিন এক এক গ্রাম ঘুরতো। আজ ঘোড়াদহ, কাল আকোইন, পরশু ভাটপাড়া-- এভাবে। সাত সকালে যে ক’টা ছোলা পাওয়া যেতো, তা কোনো গেরস্তবাড়ি থেকে ভেজে টাকটুক করে চিবুতে চিবুতে দ্বারে দ্বারে ঘুরতো। ছোলা ভাজাই ওদের এই সময় পর্যন্ত সকালের নাস্তা। তারপর সন্ধ্যার আগেই ওরা ফিরতো আস্তানায়। চাউল পাওয়া যেত না বললেই চলে। সাতদিনে হয়তো এক সের চাল মিলতো। গম, ছোলা পাওয়া যেত বেশ। আটাও পাওয়া যেত সামান্য।
প্রতিদিন ওরা দুজনে গড়ে চার সের গম আর পাঁচ সের ছোলা ভিক্ষে করে আনতো। তারপর সন্ধ্যায় গমের খিচুরী খেয়ে ক্লান্ত শরীরে সে কী সুন্দর ঘুম! এক ঘুমে একেবারে ভোর।

যারা চাল দিতো, তারা কোনো না কোনোভাবে কাছের মানুষ জেনেই দিতো। হয়তো সুভাষদের শহরস্থ মিষ্টির দোকানের দুধওয়ালা, নয়তো ওর দাদুর পাট ব্যবসার ফড়িয়া বা দালাল, অথবা পারিবারিক পরিচয়সূত্র ধরে, আবার কখনও কমলের বাবা-ঠাকুরদার ঐতিহ্যের খাতিরে।

কেউ কেউ বলতো, ‘আহারে, কী বাড়ির মানুষ আইছে আমাগের বাড়ি সাহায্যের জন্যিতি’। তারা কমল-সুভাষকে ডেকে বাড়ির ভেতর নিয়ে গুড় মুড়ি বা গুড় রুটি খেতে দিতো, আর ওদের বিপদমুক্তির জন্য আল্লাহ্‌র দরবারে ফরিয়াদ জানাতো।
কেউ আবার কিছু না দিয়ে কিছু শক্ত কথা শুনিয়ে দিতো। কখনও আবার কোনো বাড়ি থেকে বলতো, ‘কামাই কইরা খাবার পারো না?’

একদিন তো এক বাড়ির একটি সদ্যোভিন্ন বক্ষের মেয়ে ওদের পেছনে কুকুর লেলিয়ে দিলো! পরে মেয়েটির মা এসে কুকুরটিকে শান্ত করে। সেদিন সুভাষ তো বলেই ফেললো, ‘কী খচড়াদোচা মাগীরে!’ কমল সুভাষকে টানতে টানতে ঐ বাড়ি থেকে বের করে আনে। ওরা শুনতে পেলে কি আর আস্ত রাখতো সেদিন?

আর একদিন ওরা সাইচা এলাকা দিয়ে ঘুরছিলো। একটা বাড়িতে কোথাও কট্‌ কট্‌ করে কিসের যেন শব্দ হচ্ছিলো। ওরা যেই গিয়ে বলেছে, ‘এই যে, সাহায্য দিবেন?’, অমনি বাড়ির ভেতর থেকে বেড়িয়ে এলো দুজন লোক। পরপরই এলো একজন বিশ-বাইশ বছরের মহিলা। ওদের দেখে ঐ মহিলা পুরুষ লোক দুটোকে বললো, ‘অগো বাইন্ধা রাখো। তারপর মিলিটারি খবর দেও। ঐ তো ঐ গ্রামে গুলির শব্দ শোনা যায়। অরা মনে অয় শহরের ইন্দু’। এ কথা বলেই মহিলা তৃপ্তির হাসি হাসলো।
 
লোক দুটো কিছু বলার আগেই কমলরা দ্রুত বেড়িয়ে এলো সে বাড়ি থেকে। তারপর সেই যে দৌড়! এক দৌড়ে ডেরায়সেদিন আর বেশি বাড়ি ঘোরা হয়নি। ঐ গ্রামে আর একবারও যায়নি ওরা।    

[চলবে]

Sunday, April 23, 2017

মুক্তিযুদ্ধের চাক্ষুষ ঘটনা নিয়ে বাবু ফরিদীর উপন্যাস 'কমলের একাত্তর' [পার্ট ১৯]






[আগের ১৮ পর্বের পর]

গৌরদিয়া গ্রামে থমথমে ভাব বিরাজ করে। দুপুর পর্যন্ত কাইজ্যা চলে। শোনা গেলো, আগন্তুকরা ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছে। ওদেরও আহত হয়েছে অনেক। এ গ্রামে আহতের সংখ্যা বিশের উপরে। দু’জনের অবস্থা আশংকাজনক। বাঁশের সাথে কাঠ ঝুলিয়ে তাদের চিকিৎসার উদ্দেশ্যে নেয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে।

সারা রাত গ্রাম পাহাড়া চলে। সর্বত্র সতর্কাবস্থাকেউ যেন গ্রামে ঢুকতে না পারে। কমলরা উদ্বেগের সাথে রাত কাটায় দাসবাড়ি। ভুঁইয়াবাড়ির লোকজন এবাড়ি ওবাড়ি সরে থাকে। সরিয়ে ফেলা হয় মূল্যবান সামগ্রী।

ভোরে ভুঁইয়াবাড়ির সবাই আবার মিলিত হলো একত্রে। সকালবেলাই কাতরা হাতে কয়েকজন সঙ্গীসহ আফছার এলো পিসামশাইর কাছে। বলল, ‘বাবু, আপনাগো আর নাকপার পারলাম না’

পিসামশাই চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ায়। তাঁর চোখে-মুখে বিহ্বলতা। আফছার আবার বলে, ‘নুট আমরাই হরুম। আপনারা জান নিয়া সইরা দাঁড়ান’।

কাকিমা ঘরের ডানদিকে উঠানের একটি চুলায় পাতিলে ধান সেদ্ধ করছিলেন। মা তাকে চোখ ইশারা করেন। কাকিমা মায়ের ইশারামতো চুলোর কয়লা সরিয়ে আধাসিদ্ধ ধানগুলো চুলোয় ঠেলে চুলোর পর পাতিল চাপিয়ে সরে যায় মায়ের পাশে। দিদিমা, পিসি কাঁদতে কাঁদতে উঠোনে নামেন।

ইতিমধ্যেই শুরু হয় লুট। পঞ্চাশ-ষাটজনের একটি দল চড়াও হয় বাড়িতে। ‘মার মার’ শব্দে কাঠের বেড়া খুলতে থাকে ওরা। তারপর একে একে লুটে নেয় সর্বস্ব।

এক ঘন্টার মতো সময় ধরে চলে লুট। শেষমেশ এক মহিলা কাকির রাখা চুলোর সেই ধানগুলো তুলতে থাকে পাতিলে। কাকি তাকে বাধা দিতে যান। কাকুতি মিনতি করে বলেন, ‘দেখো, ঐ ধান কয়ডা থুইয়া যাও! আমাগো পোলাপানগুলা এহনও কিছু খায় নাই’।

তারস্বরে চেঁচিয়ে উঠলো মহিলা, ‘দ্যাহো, ঐ মাগী কয় কী! মাগীগো এততো মানষি নুট হইরলো, তা মাগীর সইলো। আর আমি এই ধান কয়ডা নিছি, তা ওর সয় না!’

মা কাকিকে চুপ করতে বলেন। কাকি চুলোর দিকে এগিয়ে যান, হঠাৎ ‘ও মাগো’ বলে আর্তচিৎকার দিয়ে বসে পড়েন মাটিতে। মা দৌড়ে তার কাছে যান। দেখেন, উঠোনে ছড়ানো কাঠের বেড়ার চিৎ হয়ে থাকা গজাল লোহার অর্ধেকটা কাকির পায়ে ঢুকেছে। মা তাড়াতাড়ি সেটা টান মেরে খুলে ভগবানের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘হা ভগবান! এই কি তোমার বিচার?’

ফিনকি দিয়ে কাকির পা থেকে রক্ত ঝরে। বাড়ির সবাই ভিড় জমায় কাকির চারদিকে। কেউ গাঁদা ফুলের পাতা খোঁজে, কেউ আনে দূর্বা। এভাবে কাকির শুশ্রূষা চলে অনেকক্ষণ ধরে।

ওদের ভাগ্যে খাবার জুটলো না দিনভর। সন্ধ্যার আগে ওরা সরে যায় ভুঁইয়া বাড়ি থেকে। ওঠে মেকো দাসের বাড়ি। রাতে সে বাড়ি থেকে কিছু দানাপানি জোটে ওদের। রাত ন’টায় আফছার এলো দাসবাড়ি। বাবার খোঁজ নিয়ে তার কাছে গেলো। বললো, ‘মশায়রা, তোমরা এহনও যাও নাই? যদি জানের মায়া থাহে, তয় সকালের মধ্যে এ গ্রাম ছাড়বা’।

আফছার হন্‌হন্‌ করে চলে গেলো। কমলের মা ওর বাবার শরীরে মৃদু ধাক্কা দেয়। বাবা-মায়ের মাঝে চোখাচোখি হয়। মা বললেন, ‘আফছার তোমারে তুমি কইরা বললো?’ বাবা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মাথা নামায়।

রাতে বাবার কথা হলো কাকার সাথেকথা হলো পিসামশাই ও দাদু-দিদিমার সাথে। সিদ্ধান্ত হলো, মরতেই যদি হয় তবে দেশের দিকে গিয়ে মরি। বাবা বললেন, ‘মান-সম্মানই যদি না থাকলো, তখন বেঁচে থেকেই বা লাভ কি?’

কাকা বললেন, ‘শহরের কাছের এলাকা এখন নাকি নিরাপদ। বিপদ ঢুকছে এখন গ্রামের ভেতর, প্রত্যন্ত অঞ্চলে, অজো পাড়াগাঁয়।

ভোর না হতেই কমলরা পেছনের দিকে ছুটলো। উদ্দেশ্য আপাতত ভাবুকদিয়া, তারপর ফরিদপুরের কাছাকাছি কোথাও। কিন্তু কাকিকে নিয়ে হলো ভীষণ বিপদ। জং ধরা গজাল লোহার খোঁচা বলে কথা। পায়ের তলা ফুলে ঢোল হলো। তবু তো যেতে হবে! অতি কষ্টে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে, কমলের মায়ের কাঁধে ভর দিয়ে তিনি চলতে লাগলেন পথ।

সকাল সাতটা-আটটা লাগলো ওদের ভাবুকদিয়া পৌঁছতে। প্রথমেই মা দৌড়ে গেলেন মেঝপিসির কাছে। কাকির পায়ের অবস্থা দেখিয়ে বললেন, ‘দ্যাখেন ঠাকুরমশাই, বাদলের এই অবস্থা। তাই আজকের মতো আপনার এখানে থাকবো। কাল সকালেই আমরা অন্য কোনোখানে চলে যাবো’।

পিসামশাই ভালো-মন্দ কিছু বললেন না। পিসি প্রতিবেশীর কাছ থেকে সরিয়ে রাখা চাল থেকে কিছু চাল আনলেন। উনুনে চড়ালেন রান্না। রান্না শেষে খাওয়া-দাওয়াও হলো। কিন্তু বাবা-কাকা ভীষণ চিন্তায় পড়লেন কাকিকে নিয়ে। দিনে ও রাতে দশবারের মতো গরম লবণ জলের সেক দেয়া হলো। পাকানো কাপড়ের সলতে সরষের তেলে ভিজিয়ে তাতে আগুন জ্বলে কাকির পায়ের তলায় পিটানোও হলো বহুবার।

আস্তে আস্তে ব্যাথাও কিছুটা কমে এলো এক সময়।

আবারও ভোরে শুরু হলো পথ চলা। রাতের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এবার গন্তব্য সোমসপুরের কাছাকাছি বেতবাড়িয়া। কাকির পক্ষের আত্মীয় চিত্ত রায়ের বাড়ি। তাম্বুলখানা ফুরসার মাঝামাঝি পুবের গ্রাম।

সেখানে পৌঁছে প্রথম ক’দিন তাদের খাবারই খেলো ওরা। গ্রামে হিন্দু পরিবারের সংখ্যা মাত্র দু-তিন ঘর। অবস্থাসম্পন্ন বলতে গেলে এরাই। বিশ-ত্রিশ বিঘা জমির মালিক চিত্ত বাবু। কিছু জমি নিজে চষে বাকিটা গ্রামের লোকের কাছে বর্গা দেয়া। গ্রামের মানুষের সহানুভূতি আছে তার উপর। তাছাড়া তিনি গ্রামের মানুষের বিপদ-আপদও দেখেন। বিহারি-মিলিটারি আতংক হয়নি এখনও।

কমলরা সব দিক ভেবে এখানে থাকাটা নিরাপদ মনে করলো। একটু এদিক-ওদিক ঘোরাফেরা করতে পারলে খাবারের কোনো কষ্টই হবে না। কৈজুরী, আকোইন, ভাটপাড়া, ঘোড়াদহ, মঙ্গলকোট এখান থেকে কাছেই। ওসব গ্রামে কাকার পরিচিত কাঠের ব্যাপারী ফড়িয়া, মিষ্টির দোকানের দুধ যোগানদার বাবার রোগী, পুরাতন বর্গাদার বন্ধু-বান্ধব অনেকেরই বাড়ি। তাদের কাছে গেলে একভাবে না একভাবে চলেই যাবে দিন।

কমলের বাবা-কাকা এগ্রাম-সেগ্রাম করতে থাকেন। ফেরার সময় কিছু হাতে করে নিয়ে ফেরেন। কমল-সুভাষও বসে থাকে না। সকালে শুরু হয় গ্রামের দিকে উদ্দেশ্যহীন যাত্রা, আবার সন্ধ্যার আগেই বাড়ি ফেরার তাগিদ। আজ মঙ্গলকোট, কাল ভাটপাড়া তো পরশু অমুক গ্রাম। 

এভাবেই কাটে বেশ কিছুদিন। কোনোমতে জোটে দুটি পরিবারের দুবেলা আহার। গমের খিচুরী আর শাকপাতা। মাঝে মধ্যে খিচুরীর মধ্যে যোগ হয় কাঁচা কাঠালের তরকারী। বাবা-কাকা ও কমল-সুভাষ গম-ছোলা আনেন। মা-কাকি সেসব ঢেঁকি-জাতায় পিষে খোসা ছাড়ান। 

প্রথম প্রথম খোসা ছাড়ানো গম আর ছোলার খিচুরী পেটে সহ্য হতো না কারো। এখন এসব ছোট-বড় সবার কাছেই মানানসই হয়ে গেছে। যতটা হাদ্য, ততটা মল। এ থেকেই বেঁচে থাকে শরীর। কেটে যায় দীর্ঘ আড়াই মাস সময়...

[চলবে]

Saturday, April 22, 2017

মুক্তিযুদ্ধের চাক্ষুষ ঘটনা নিয়ে বাবু ফরিদীর উপন্যাস 'কমলের একাত্তর' [পার্ট ১৮]






[আগের ১৭টি পর্বের পর]
একদিন বাবার সাথে কমল গেলো নতুবদিয়া। গৌরদিয়া থেকে পাচ-মাইল গেলে নগরকান্দা-বোয়ালমারীর বর্ডার। ওখানকার মাটিতে পা দিতেই ছাত্রনেতা শরীফ আফজাল হোসেন, শাহ জাফরের কথা মনে পড়লো কমলের। অল্প দূরেই গোপালগঞ্জ, বঙ্গবন্ধুর জন্মস্থান। নতুবদিয়া বাজারে দেখা মিললো বন্ধুর কাকা, গুরুদাস কাকার সাথে। কথা হলো পবিত্র কাকা বন্ধুর সাথে। দিন যাবৎ মামিরা এখানে আছে। দিন পরেই নাকি অন্যত্র চলে যাবে।
 
কমলের বাবা সকলের সাথে কথা বললেন। কথার মাঝে ফরিদপুর শহরের নিলটুলী এলাকার জন স্বর্ণকারের সাথে দেখা কথা হলো। জানা গেলো, ফরিদপুর শহরের কিছু কিছু হিন্দু শহরে ফিরতে শুরু করেছে। নাপিত, ধোপা, চর্মকার, মেথর, ডোম জেলে সম্প্রদায়। নতুন এক আদেশে সরকারী কর্মচারী হিন্দুরাও জেলেদের মধ্যে শহরে ঢুকবে। মামাও নাকি কাজে যোগদানের কথা ভাবছে।

বাবার মন আনন্দে নেচে ওঠে। যতটা জানা গেলো, শহরের অবস্থা এখন স্বাভাবিক, তবে মিলিটারিরা বিহারিরা নাকি গ্রাম অপারেশনের কথা ভাবছে। গোপালগঞ্জের গ্রামের মানুষ হিন্দু-মুসলমান সবাই এখন পর্যন্ত পবিত্রই আছে। তবে মিলিটারি আতংক মাঝে মধ্যে হয়। কিন্তু অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে ভয় মাঝে মধ্যে সাহস সঞ্চার করে।

সেদিন সন্ধ্যার পর ওরা গৌরদিয়া ফিরলো। সেখানে কেটে গেলো আরও কিছুদিন।

হঠাৎ করেই এক সময় গৌরদিয়াবাসীর মানসিক অধঃপতন ঘটতে থাকে। মুখে মুখে আসতে থাকে বিভিন্ন এলাকার লুটের খবর। কিন্তু ভুঁইয়াবাড়ির ব্যাপারে সবারই শ্রদ্ধাবোধ অটুট থাকে। তবে লুটের মাল গৌরদিয়ার ঢুকে অনেকের ভেতরেই লালসা জাগায়।

ভুঁইয়া দাদু একদিন হঠাৎ কমল আর সুভাষকে ডেকে বললেন, ‘দাদু, এভাবে বসে বসে খাওয়া ঠিক হচ্ছে না। তোমরা দু’জন বরং ঐ পালানের ধানক্ষেতটা নিড়িয়ে আসো’।

দাদুর অঙুলি নির্দেশ লক্ষ্য করে সুভাষ এক বাক্যে রাজী হয়ে যায়। কমল ভাবে অন্য কথা, ‘শ্যামল রবিরা থাকতে আমাদের দু’জনকে বললো কেনো?’ আর মুখে বললো, ‘দাদু, আমরা তো চিনি না কোনটা ধানগাছ আর কোনটা আগাছা’।

দাদু বললেন, ‘যে গাছের পাতা ধার, হুল হুল আর পাতার গোড়ায় মালার মত, সেটা রেখে বাকিটা তুলে ফেলবে। তারপর দুপুরে, নারকেল গাছ থেকে যত পারো ডাব-নারকেল পেড়ে খাবে’।

সুভাষের উৎসাহ বেড়ে গেলো। নিড়ানী নিয়ে ওরা ছুটলো পালানে। কড়া রোদে বেশ কিছুক্ষণ নিড়িয়ে সুভাষের জলের তৃষ্ণা পেলো। কমলও তার পিপাসার কথা জানালো। সুভাষ পাশের বাড়ির দিকে ছুটলো আর বললো, ‘আমি জল খেয়ে তোর জন্য জগে করে নিয়ে আসি’।

কমল নিড়িয়ে চলে, আর সুভাষকে লক্ষ্য করেসুভাষ বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে জানালায় কার সাথে যেনো কথা বললো। কিছুক্ষণ পর জলের জগ আর গ্লাস হাতে ও বাড়ির মেয়ে বিজলী এলো। সুভাষ জল খেতে খেতে বিজলীকে কী যেন বললো। বিজলীর চোখে বিদ্যুৎ খেলে গেলো। চোখ নামিয়ে অদ্ভুত মেয়েলি ঢঙে মাথা ঝাকালো। সুভাষের মুখে দুঠুমির হাসিও কমলকে একবার দেখে নিয়ে বিজলীর দিকে দু’পা এগিয়ে গেলো। কমল তখন নিমগ্নচিত্তে নিড়াচ্ছে, এমন ভাব মুখে এনে নিড়ানী চালাতে থাকলো। দাদার চোরা দৃষ্টি সম্বন্ধে আজ্ঞই থেকে গেলো সুভাষ।

ভুঁইয়া দাদু ধীর পায়ে এগিয়ে আসেন কমলের সামনে। নিড়ানো দেখেন। সহসা চেঁচিয়ে ওঠেন, ‘করো কি করো কি দাদু! সর্বনাশ করে ফেলেছো! তো, আর এক পণ্ডিত কোথায়?’ কমল হাতের ইশারায় সুভাষকে দেখায়দাদু সেদিকে চোখ রাখেন। বলেন, ‘ওহ, এ জন্যই বুঝি নিড়ানোর আগ্রহ ওর বেড়ে গিয়েছিলো! আমি তো ভেবেছিলাম পণ্ডিতরা আমার কী উপকারটাই না করছে! যাও, যাও আর নিড়াতে হবে না’।

কমল লজ্জা পায়। বলে, ‘দাদু, এবারে আর ভুল হবে না’।

‘ঠিক আছে। যা ভালো মনে করো, করো। দেখো গরম-টরম লাগিও না আবার’।

দাদু চলে যান। সুভাষ ফিরে আসে। কমল নিড়াতে থাকে। এভাবে কেটে গেলো আরও ক’টি দিন।

একদিন রাতে আফছার পিসামশাইকে ফিস ফিস করে কী সব যেন বললো। পিসামশাই চিন্তিত হয়ে পড়লেন। বাবলুদাকে সরিয়ে দেবার ব্যাপারে দাদুর সাথে আলাপ করলেন। বাবা-কাকার মধ্যে আলোচনাকালে কমল যেটুকু বুঝলো তা হলো, সারুকদিয়ার বোসবাড়ি হামলার প্রস্তুতি চলছে। কারা নাকি রামদা সুরকি নিয়ে বোসবাড়ি ঘিরে রেখেছে। অধীর বোসকে খুন করার আর ওবাড়ির মেয়েদের তুলে নিয়ে যাবার ষড়যন্ত্র চলছে। নগরকান্দা, গোট্টী ও আটঘর এলাকার স্বাধীনতাবিরোধীরা নাকি একজোট হয়েছে।

রাতভর ভুঁইয়াবাড়ির কারো চোখে ঘুম এলো না। ছোটরা ঘুমোয় আর বড়রা তাঁদের সজাগ করে। রাত তিনটের দিকে বাবলুদাসহ গ্রামের ছেলেমেয়েদের নিয়ে বিশ জনের একটি দল ভারত অভিমুখে গ্রাম ছাড়লো। কমলের মা ওর বাবাকে অনুরোধ করলেন, যেন কমলকে ওদের সাথে ছেড়ে দেন। বাবা বললেন, ‘জনপ্রতি একশ করে টাকা দিতে হচ্ছে। আমার তো এক টাকাও নেই। যা ছিলো তাও তো সেদিন ওরা কেড়ে নিলো’।

কমলের মা আর কথা বাড়ালেন না।

পরদিন সকালেই বোসবাড়ির খবর জানা গেলো। ও বাড়ির সাত-আটটি পরীর মতো সুন্দরী  মেয়ে অভিনব কায়দায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে। কেউ রাখালের বেশে বদনা হাতে, আবার কেউ প্রতিবেশী মুসলমান ঝি-বউদের সাথে ওদের শাড়ি পরে ওদের একজন হয়ে কলসী কাঁখে প্রথমে মুসলমানদের বাড়িতে উঠেছে। তারপর ওদের সহায়তায় রাতারাতি ভারতের পথে গ্রাম ছেড়েছে। আর অধীর বোস পালিয়েছেন অন্যভাবে। মেয়েরা নিরাপদে সরে যাবার পর বাড়ির লোকেরাই লাঠি-সোটা দা দিয়ে টিনের বেড়ায় এলোপাথাড়ি আঘাত করে তুলে নেয়। যারা বোসবাড়ি ঘিরে ছিলো, তারা ঐ দিকে জড়ো হলে বাড়ির অন্য দিক দিয়ে অধীর বোসসহ আরও দু-চারজন পালিয়ে যান। স্বাধীনতাবিরোধীরা নাকি এখন বোসবাড়ি আগুন দেবার কথা ভাবছে।

 দুপুরে আফছার এলো পিসামশাইয়ের কাছে। বললো, সালথা-গোট্টির লোকজন নাকি সারুকদিয়া গৌরদিয়া লুট করার পায়তারা করছে। আফছার আরও বললো, ‘সারুকদিয়া ওরা নুট হরে হরুক, গুরদিয়া নুট হরবার দেবোনা। এতি জান ধরে থাক আর যাক’।

পিসামশাই তাকে বলে, ‘লুট হয় হবে। তুমি এ জন্য মাথা গরম কোরো না আফছার। তোমরা তো আমাদের জন্য কম করছো না’। কমলের বাবা-কাকাও পিসামশাইর কথায় সায় দেয়।

আফছার বলে, ‘না বাবু, এডা আমাগোর মান-ইজ্জতের ব্যাপার। আমরা থাকতি এ গ্রাম নুট হরবি সারমা-গোট্টীর মাইনষে? এডা অয় না’

পরদিন ভোরে গ্রামের চারদিকে চিৎকার-শোরগোল শোনা গেলো। ভুঁইয়া বাড়ির সবাই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়লো। শুনতে শুনতে শোনা গেলো, কারা যেন ঐ গ্রাম লুট করতে আসছে। গৌরদিয়ার মানুষ তাদের ঢুকতে দিচ্ছে না। খাল পাড়ে দু’দলের মধ্যে কাইজ্যা চলছে।

কমল কোনোদিন কাইজ্যা দেখেনি। ও খুব চঞ্চল হয়ে ওঠে। সুভাষকে নিয়ে ও সেদিকে ছোটে। গ্রামের নারী-পুরুষ সেদিকে ছোটাছুটি করে। কারো হাতে ঢাল, কারো হাতে বল্লম কাতরা সড়কি। মাঝবয়সী মহিলারা সেদিকে ছোটে আর হিন্দুদের উদ্দেশ্যে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে। কেউ কেউ ভোটের গুষ্টি মারে। আবার কেউ শেখ মুজিবের উদ্দেশ্যে বকা দেয়।

ভাব-সাব বেগতিক দেখে কমল আর সুভাষ বোসবাড়ির ধারে একটি আমগাছে উঠে ডালে গিয়ে বসে আর লোকজনের যাতায়াত দেখে। এক সময় সুভাষকে নিষ্প্রাণ দেখে কমল প্রশ্ন করে, ‘কি রে, তোর ভয় করছে?’

সুভাষ মাথা নড়ায়, ‘না’।

‘তবে?’

‘বিজলীরা চলে গেছে ভারতে’।

‘ও, এই কথা? তাতে তোর কি হয়েছে? যাবে না? প্রাণের মায়া, বড় মায়া। দ্যাখ আমাদেরই কার কোথায় যেতে হয়!’

এমন সময় দু’জন আহত লোককে ধরাধরি করে নিয়ে যেতে দেখা গেলো। তার বাম পাজরে রক্তের চিহ্ন। গামছা দিয়ে বাঁধা। লোকটি কাতরাচ্ছে। 

        কমলের বুক কাঁপে রক্ত দেখে। এতদিনে ভোলা জ্যাঠার কথা মনে পড়ে। চোখের সামনে ভেসে ওঠে ভোলা জ্যাঠার প্রাণহীন উদোম শরীর। ওর চোখ হলদে হয়ে আসে। ঝাপসা হয়ে আসে দৃষ্টি। ও তাড়াতাড়ি গাছ থেকে নেমে ছুট দেয় আস্তানায়। পেছনে পেছনে সুভাষ।

 [চলবে]