নানা স্মৃতি নানা কথা মাথার মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে রাতে কমলের ঘুম এলো
না। ভোরে বিছানা ছেড়ে হাত-মুখ ধুতেই ওর কাকা বললো, ‘চলো কাকু, আজ আমরা দুজন
মঙ্গলকোট যাই। দেখি ওখান থেকে কিছু আনতে পারি কিনা’।
কমল রাজী হলো। কাকা তৈরি হয়ে
নিলো।
কাকা মঙ্গলকোট গ্রামে ঢুকে সোজা সফি পরামানিকের বাড়ি উঠলো। উনি একজন
আওয়ামী লীগ কর্মী। খোঁজ নিয়ে জানা গেলো, সফি সাহেব বাড়ি ছেড়েছেন আজ তিনমাস। বাড়িতে
দিনের বেলা শুধু মেয়ে মানুষ আর কমবয়েসী পুরুষরা থাকে। রাতে পুরুষলোকেরা আসে, আবার
ভোর হতেই সরে যায় অন্য কোনোখানে।
বাড়ির লোক কাকার পরিচয় পেতেই কমলদের বসতে দিলো। সফি সাহেব কাকার
ময়রাপট্টির দোকান ঘরটি কিনেছেন তিন বছর ধরে। তাছাড়া কাকাদের সাথে ব্যবসায়ও
অংশীদারিত্ব আছে। আসা-যাওয়া, ওঠা-বসায় কাকা ওদের খুব কাছের মানুষ জেনে এবং কাকার
মুখ থেকে নানান রকম দুঃখ কষ্ট ও বঞ্চনার কথা শুনে বর্ষীয়ান মহিলারা অশ্রু বিসর্জন
দিলেন। তারপর পুকুর থেকে মাছ ধরালেন, উনুনে চড়ালেন ভাত।
গল্পে গল্পে এক সময় রান্না শেষ হলো। কমলরা খেতে বসলো। লাল লাল দেশী
চাউলের ভাত, মাছের ঝোল। ঈশ্, কী মজাটাই না হলো খেতে বসে! এই তিনমাস ভাত ওদের
ভাগ্যে জোটেনি। খোসা ছাড়ানো গমের সাথে কিছু চাউল মিশতো ঠিকই, কিন্তু তা খিচুরীতে
গিয়ে গমের পাশে অস্তিত্বহীন হয়ে যেত।
খাওয়া শেষে লবণে আটকে যাওয়া এবং মাটিতে পড়ে থাকা কিছু ভাত সবার
অলক্ষ্যে তুলে ধুয়ে মুখে পুরলো কমল। কাকাও খাওয়া শেষে তৃপ্তির শ্বাস ফেললেন। মুখে
দিলেন পান। টানলেন হুকো।
উঠবার সময় সফি সাহেবের মা কাকার হাতে তুলে দিলেন একটি চালের পোটলা।
ক’দিন যেতেই বেতবাড়িয়ার ভাবও খারাপ হয়ে গেলো। ছোটখাটো দু’চার ঘর
হিন্দু যা ছিলো তাদের অনেকেই দেশ ছেড়ে চলে গেছে। যারা আছে তারাও পরাস্ত, যাবার
পায়তারা করছে। চিত্তবাবু বাড়িঘর জমা রেখে দেশ ছাড়তে চায় না। এতদিনের তিলতিল করে
গড়ে তোলা সংসার, বাবা-দাদার ভিটেমাটি ছেড়ে যেতে কি মন যায়?
গ্রামের মানুষও তাঁকে
গ্রামেই রাখতে চায়। কিন্তু মুশকিল বাধিয়েছে দু’চারজন টাউট। গ্রামের মানুষ
সংঘবদ্ধভাবে তাদের প্রতিরোধ করতে গিয়ে নিজেরাই বিপদে জড়িয়ে যাচ্ছে। শোনা গেলো,
টাউটরা নাকি শহরে যোগাযোগ করে বিহারি ভাড়া আনার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।
প্রতি রাতে রায় বাড়িতে মিটিং বসে। কী করা যায় এ নিয়ে চিত্তবাবু কাছের
মানুষদের সাথে মত বিনিময় হয়। গ্রামের মাতুব্বর ও মুরুব্বিরা আসে, আড্ডা দেয়,
পান-তামাক শেষে বিদায়। এক্ষেত্রে কমলদের পরিবার থাকে নীরব শ্রোতা। ওরা বিদেশী, আজ
আছে কাল নেই, চাল আছে চুলো নেই অবস্থা। এ অবস্থায় ওদের পরামর্শ-উপদেশ দেবার বা
নেবার প্রয়োজন কেউ মনে করে না।
এরই মধ্যে কাকার কাছে একটি চমৎকার খবর এলো। খবরটি কাকাকেও আকৃষ্ট
করলো। খলিলপুর কাকার ভায়রাবাড়িতে কিছুদিন আগে বিহারিরা স্থানীয় লোকদের সহায়তায়
অপারেশনে যায়। তারা বাড়ির পুরুষদের ধরে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে গুলি করতে যাবে,
এমন সময় ঘরের ভেতর থেকে ছুটে আসে একজন বিহারি। হাতে তার রাইফেলের পাশাপাশি একটি
ছবি। ছবিটি দেখিয়ে বাড়ির পুরুষদের কাছে তাদের পরিচয় জানতে চায় সে। সাহসের উপর ভর
করে তারা জানায় ছবির ঐ লোকটি আমাদের আত্মীয়। কাকার ভায়রা সগর্বে বলে উঠে, ‘উনি
আমার বদ্রীর দুলাভাই’।
সঙ্গে সঙ্গে সকল বিহারির মধ্যে কথোপকথন হয়। তাক করা
রাইফেলের নল নেমে আসে। কারণ হিসেবে জানা গেলো, আলীমুজ্জামান সেতুর গোড়ায় বাসা
সংলগ্ন কাকার যে লন্ড্রিটি ছিলো, সেখানে ওরা কাকাকে দেখেছে। ওদের ধারণা কাকা পেশায়
ধোপা। আর ধোপার আত্মীয় হিসেবে এরাও ধোপা। ধোপা নাপিত জেলে—এদের হত্যা করা এখন
বেআইনী। কাজেই, বেঁচে যায় তারা।
এ খবরে কাকার মনে শহরে ফেরার স্পৃহা বেড়ে যায়। মনে মনে পরিকল্পনা
আঁটে বেতবাড়িয়ার পরিবেশ ঘোলাটে হবার আগেই তারা খলিলপুর গিয়ে উঠবে। সেখান থেকে খোঁজ
খবর নিয়ে সোজা শহরে গিয়ে লন্ড্রী খুলে বসবে।
কমল ভাবে অন্য কথা। সে মুহূর্তে ওর ছোট পিসামশাইর কথা মনে পড়ে। কাকা
তার বাসায় লন্ড্রী আর দশ আনা- ছয় আনা ভাগে সেলুন দিয়েছিলেন বলে পিসামশাই কাকাকে
বলেছিলেন, ‘কায়স্থ-কুলিন ঘরের ছেলে শেষ পর্যন্ত ব্যবসা আর পেলো না! একেবারে
ধোপা-নাপিত? জাত-পাত আর রাখবে না এরা। এদের সাথে সম্পর্ক রাখাটাও এখন পাপের’।
কমল ভাবে, নিয়তির কী খেলা, আজ ধোপা পরিচয়েই কতগুলো মানুষের জীবন
রক্ষা পেলো!
চৈতবাড়িয়া সংকটে কাকার জন্য একটা পথ খোলা থাকলেও বাবার জন্য কাকা
চিন্তিত। বাবাও বিচলিত। কাকার সাথে খলিলপুর যাবার প্রস্তাবে বাবা অমত করেন।
একদিন বাবা কমলকে নিয়ে তুলাগ্রামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন। কবিরপুরের
শেষ মাথায় বাবার এক পুরানো বন্ধুর বাড়ির খোঁজ করতে করতে পেয়ে গেলেন। জানা গেলো,
বাবার সে বন্ধু তিন বছর হলো মারা গেছে। তার অন্ধ বৃদ্ধা মা-বাবার পরিচয় পেয়ে
কিছুক্ষণ ছেলের শোকে কাঁদলেন। তারপর বাবার সাথে গল্পে গল্পে সময় কাটালেন। সেই
ফাঁকে ছেলে-বৌকে দিয়ে ভাত রাধালেন এবং খেতে দিলেন।
কমলের বাবা শুধু এক গ্লাস জল খেলেন। কমল ভাত খেতে লাগলো। বৃদ্ধা
বাবার সাথে কথা বলার ফাঁকে কমলের মাথা মুখমন্ডল হাতিয়ে দেখতে লাগলেন কমল ভাত মুখে
দিচ্ছে কিনা, অর্থাৎ খাচ্ছে কি না। এমন আদরমাখানো পরশ এ তিন-মাসে কমল কারো কাছ
থেকে পায়নি বিধায় অশ্রু আর ধরে রাখতে পারলো না। কমলের চোখের কোণে অশ্রু অনুভব করে
বৃদ্ধাও কেঁদে ফেললেন।
খাওয়া শেষে বৃদ্ধার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তুলগ্রাম ঢুকে বাবার যেন
সৌভাগ্যের চাবি মিললো। গ্রামবাসী তিনমাস যাবৎ একজন ডাক্তারের অভাব বোধ করছিলো।
বলাই ডাক্তারকে মেরে ফেলার পর অনভিজ্ঞ সোনা ডাক্তার গ্রামবাসীর চিকিৎসা করছিলো।
কিন্তু সে কুলিয়ে উঠতে পারছিলো না। গ্রামবাসী অনুরোধ করলো বাবা যেন তাদের গাঁয়ে
ফিরে আসেন এবং প্রাকটিস শুরু করেন। বাবা তাদের কথা দিয়ে এলেন। কমল লক্ষ্য করলো,
শহরের কাছাকাছি গ্রামগুলোই এখন বেশী শান্ত ও শান্তিময়।
বেতবাড়িয়া ফিরতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। রায়বাড়ির উঠোনে পা রাখতেই দেখলো,
রায়মশাই ক’জন মানুষের সাথে কথা বলছে। তারা যেভাবেই হোক গ্রামে রাখতে চায় চিত্ত
রায়কে। কিন্তু কিভাবে?
এসময় প্রস্তাব এলো, চিত্ত রায় মুসলমান হলে আর কোনো অসুবিধা হবে না।
চিত্ত রায় কিছুক্ষণ কোনো জবাব দিলো না। তারপর বললো, ‘আমারে কয়টা দিন সময় দেন। আমি
একটু ভাবি’।
[চলবে]