ঘড়ির কাটা জানিয়ে দিল বিকেল সাড়ে পাঁচটা বাজে । তার মানে হাতে আর সময় নেই । ঘণ্টা বাজার সাথে সাথেই স্যাররা খাতা তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন । শ্রাবণের পরীক্ষা অনেক আগেই শেষ । প্রস্তুতি খুব একটা ভালো না, তাই যতটুকু উত্তর জানা ছিল লিখতে তেমন একটা সময় ওর লেগেনি । তবুও বসে থাকা- শেষ মুহূর্তে যদি কোন প্রশ্নের উত্তর মাথায় আসে এই আশায় । ও আজ পরীক্ষা হলে এসেছে দেরি করে,তাও প্রবেশপত্র ছাড়া!
ভাগ্যিস ওকে সব স্যারেরা ভালো করে চেনেন এবং খুব স্নেহ করেন তাই সমস্যায় পড়তে হয়নি, দু-চারটে বকুনির ওপর দিয়েই গেছে । তফাজ্জল স্যার তো বলেই ফেললেন, “তুমি এখানেও লেট?!” শ্রাবণ একটু লজ্জিত হাসি হেসে নিজের আসনের দিকে এগিয়ে যায় । পরীক্ষা দেয় আর বসে বসে অনেক কিছু ভাবে । এই কাজটা বিনামূল্যে করতে পারা যায়, তো ভাবতে দোষ কি?
শ্রাবণ ভেবে যায় । ওর মতে, জীবিত অবস্থায় একমাত্র পরীক্ষা হলেই মানুষ বুঝতে পারে সে কতটা একা । তাও যদি হয় কার্জন হলের মতো জায়গায়, যেখানে দেখাদেখি করার বিন্দুমাত্র সুযোগ নেই । তিনতলা হলরুমটির মাঝখানে অনেকটা শপিং মলের মতো- ফাঁপা, দুইদিকে দরজা । উপরে দাঁড়িয়ে নিচের সব দেখা যায় । সামনের স্যারদের বসার জায়গাটাও অনেক উঁচু, ঐ পাটাতনে বসে পুরো হলরুমে কে কি করছে সব দেখা যায় । পরীক্ষার্থীদের বসার ব্যবস্থা আলাদা আলাদা ডেস্কে, একটা ডেস্ক থেকে আরেকটির দূরত্ব কমপক্ষে একহাত । সাথে স্যারদের কড়া গার্ড তো আছেই । শ্রাবণের এসবে মাথা ব্যাথা নেই । ও ছোট থেকেই একা একা পরীক্ষা দিতে অভ্যস্ত । ছোটবেলায় ভালো ছাত্র ছিল, তাই একা একাই ভালো পরীক্ষা দিত; আর এখনও একা একাই দেয়- শুধু রেজাল্টটা ভালো হয়না । না পড়লে পরীক্ষা ভালো হবে কি করে ?
ইশতিয়াক স্যার এসে শ্রাবণের খাতাটা নিয়ে গেলেন । আশেপাশে তাকাল শ্রাবণ । ভালো ছাত্র বন্ধুরা সব মুখ কাল করে হল থেকে বের হচ্ছে, আর যারা শ্রাবণের মতো বা তার চেয়েও খারাপ ছাত্র তাদের মুখে হাসি । চিন্তা না থাকলে যা হয় আরকি । ভাবটা এমন যে পাস করলেই হয়, আর পাশের মতো পরীক্ষা ওরা দিয়ে ফেলেছে । শ্রাবণ হাসেনা । মুখ কালো করেও থাকেনা । এই মুহূর্তে ওর প্রচণ্ড পরিশ্রান্ত লাগছে । সাথে যোগ হয়েছে রাত জাগার ক্লান্তি ।
“টানা ৪ ঘণ্টা পরীক্ষা দেয় মানুষ?” -ভেতরে ভেতরে এই ডিপার্টমেন্টে ভর্তি হওয়ার জন্য নিজেকে গালি দেয় ও । তালা হাতে মামার তাড়া খেয়ে ধীর পায়ে হল থেকে বেরোয় । বন্ধুদেরকে একসাথে আড্ডা মারতে দ্যাখে ও । যথারীতি পরীক্ষার আলাপ । কার কেমন হল... কোন প্রশ্নের উত্তর কত...প্রশ্ন কেমন হয়েছে- সোজা না কঠিন -এসব নিয়েই আলোচনা । শ্রাবণ কিছুক্ষণ ওখানে দাঁড়ায় । বন্ধু-বান্ধবিরা কেউ কেউ জানতে চায় ওর পরীক্ষা কেমন হল । কোন উত্তর না দেয়াটাই সমীচীন মনে হয় ওর কাছে । “ভালো ছাত্রদের কাছে নিজের পরীক্ষা খারাপ দেয়ার কথা বলে লাভ কি? করুণা আর দু-একটা সান্ত্বনা বাক্য ছাড়া কিছু জুটবে?”- ও ভাবে । শার্টের বোতাম আরেকটা খুলে দিয়ে উদাস মনে হাঁটতে থাকে শ্রাবণ । মোবাইলের হেডফোনটা কতদিন ধরে বিকল হয়ে পড়ে আছে, তাই পছন্দের গানগুলাও মোবাইলে শোনার সুযোগ নেই । হাঁটতে হাঁটতে মাঠের মাঝে এসে দাঁড়ায় ও । কার্জনের অপরূপ প্রকৃতি এই মুহূর্তে ওকে একদমই টানছে না । কিছুই ভালো লাগছেনা ওর । মাথাটাও ঝিমঝিম করছে ।
হঠাৎ পকেটের ভেতর কি যেন একটা কেঁপে উঠলো । হাত দিয়ে মোবাইলটা চোখের সামনে ধরতেই ওর চোখজোড়া চকচক করতে লাগলো । মুহূর্তেই সব ক্লান্তি, সব অবসাদ কোথায় যেন হারিয়ে গেল । যেন কোন এক আলাদীনের চ্যারাগ পেয়েছে ও, যা ওর মনকে মুহূর্তে ভালো করে দিয়েছে । আর সময় নষ্ট করেনা ও । দ্রুত হলের দিকে এগোয় । রুমে পৌঁছতে মোবাইলের পর্দায় আরও একটি কাজ ভেসে ওঠে, যা করা ওর জন্য খুবই জরুরী । শ্রাবণ ঘড়ি দ্যাখে, সময় হিসেব করে । “নাহ, কাল করবো । আজ থাক ।”- ভেবেই কাজ ফেলে বাসের জন্য ছোটে ।
হলের পুকুর পাড়ে পৌঁছতেই শ্রাবণের পেটটা চোঁ-চোঁ করে ওঠে । হঠাৎ মনে পড়ে ওর আজ দুপুরে কিছুই খাওয়া হয়নি পরীক্ষার চিন্তায় । কিন্তু খেতে গেলে দেরি হয়ে যাবে এই ভেবে ও খাওয়ার চিন্তা বাদ দেয় ।
বুলেটের দোকান থেকে রুবেল হাঁক দেয়, “দোস্ত পরীক্ষা কেমন দিলি?” -“দিলাম আর কি। তাড়া আছে রে যাই । পরে কথা হবে ।”- বলে অল্প কথায় বিদায় নেয় শ্রাবণ । মনের পর্দায় ভেসে ওঠে অথই এর মুখ । ঠিক ৪ দিন আগে ও বলেছিল আজ যেতে । হাতে একদম সময় নেই । তাই ওর এত তাড়াহুড়া ।
অথই শ্রাবণের নতুন ছাত্রী । ক্লাস নাইনে পড়ে । শ্রাবণ ওকে মাত্র দেড় মাস ধরে পড়ায় । এরই মাঝে অথইকে শ্রাবণের অল্প অল্প করে ভালো লাগতে শুরু করেছে । অথইয়ের নীরব সম্মতি, সেজে গুজে পড়তে আসা, খোঁজ-খবর নেয়া, মিষ্টি হাসির মায়া আর মায়াকরা চোখের চাহনি- এসবই শ্রাবণকে এই ভালো লাগায় উৎসাহ দিয়েছে । শ্রাবণ বাসে ওঠে । ঠেলাঠেলি করে একটু জায়গা করে দাঁড়ায় । খুব বেশি দূরের পথ না । কিন্তু জ্যামটা খুব ভোগায় ।
জ্যামে দাঁড়িয়ে শ্রাবণের মনে পড়ে যায় সেই দিনটির কথা, যেদিন অথইয়ের সাথে শ্রাবণের প্রথম দেখা । শ্রাবণ বরাবরই রাত জাগে আর দিনে ঘুমায় । ওইদিনও তাই করছিল । রুমমেট ঘুম থেকে ডেকে তুলল । প্রথমে পাত্তা না দিলেও “টিউশনি” শব্দটি কানে ঢুকতেই আর ঘুমিয়ে থাকতে পারলনা ও । বহুদিন ধরে টিউশনি নেই, হাত খালি । ৫ মিনিটে আড়মোড়া ভেঙ্গে উঠে ভালো করে খবর নিয়ে বাইরে বেরুল ও । অনেকদিনের অনিয়মে চেহারার অবস্থা খারাপ । এ অবস্থায় কোন ভদ্রলোকের বাড়িতে যাওয়াটা ভালো দেখায় না । তাছাড়া নতুন টিউশনি বলে কথা । এমন এলোমেলো অবস্থায় দেখলে অভিভাবক টিউশনিতে নাও রাখতে পারে । সেলুনে গিয়ে তড়িঘড়ি করে নিজেকে কিছুটা গুছিয়ে নিয়েই রওনা হয় ও ।
পরিচিতিমূলক পর্বে অথই এর পরিবারের সবার সাথে অনেকক্ষণ কথা হয় ওর, সবাই ওকে খুব আপন করে নেয় প্রথম দিনেই । অথই পুরো সময়টা সোফার পিছে শ্রাবণের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে শ্রাবণকে দেখেছে, আর মনে মনে ওজন মেপেছে । ওর সম্মতি নিয়েই ওর বাবা-মা পাকা কথা দিয়েছেন । শেষে ছাত্রীর সাথে শিক্ষককে পরিচয় করিয়ে দেয়া হল । শ্রাবণ এই প্রথমবার অথইয়ের দিকে ভালোভাবে তাকাল । কিন্তু বেশীক্ষণ তাকাতে পারলনা ও । অন্য দিকে চোখ সরিয়ে শুধু মুখে বলল, “হাই!” এই তাকিয়ে না থাকতে পারার পিছে শুধু অথইয়ের মায়াবী সৌন্দর্যই একমাত্র কারণ ছিলনা- আরও কিছু ছিল; যা শ্রাবণ এখন বোঝে ।
প্রথম প্রথম শ্রাবণ অথইয়ের দিকে একেবারেই তাকাতে পারতো না । অসম্ভব সুন্দর একটি মেয়ে ওর পাশে বসে গণিত করবে, আর তার ভাষাময় অসম্ভব সুন্দর চোখদুটোর দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিকভাবে কথা বলে যাবে এতটা পুরুষ হয়ে উঠতে পারেনি তখনও শ্রাবণ । আস্তে আস্তে প্রয়োজনের তাগিদেই চোখা-চোখি, একে অন্যকে বোঝার চেষ্টা শুরু হল । ছাত্রী-শিক্ষকের মাঝে ভালো বোঝাপড়া না থাকলে পাঠদান ফলপ্রসূ হয়না, বোঝার ঘাটতি থাকে- এই ধারণাই শুরুতে ওদেরকে কাছে আনল । আস্তে আস্তে হাসাহাসির সাথে মান-অভিমানের পালাও শুরু হল । প্রতিদিন পরিয়ে ফেরার পথে শ্রাবণের কেন জানি খুব খারাপ লাগে, বুকের ভেতর কথায় যেন চিনচিন ব্যাথা অনুভব করে ও ।
শ্রাবণ অথইকে নিয়ে চিন্তায় পড়ে যায় । ওকে কোনদিন অথই “ভাইয়া” বা “স্যার” বলে ডাকেনি । বিষয়টি শ্রাবণকে ভাবায় । পারত পক্ষে “আপনি” বলে সম্বোধন করা থেকেও বিরত থাকে ও । শ্রাবণ এর পরিণতি ভেবে শঙ্কিত হয়,মনকে শাসায় নিজেই,
“ও ছোট । ও ভুল করলেও আমি করবোনা । আমার ওর থেকে দূরত্ব রেখে চলতে হবে । তাছাড়া ধর্মের বিশাল বাধা তো আছেই ।”
কোনদিন শ্রাবণের আসতে দেড়ি হলে অথইয়ের মুখে রাজ্যের অভিমানের মেঘ ভড় করে । ওর চোখের ভাষা বুঝতে পেরে শ্রাবণের মুখটাও কাল হয়ে যায় । মাথাটা নিচু করে ও বলে, “সরি, আর হবেনা । ” অথইকে পড়াতে আসলে শ্রাবণ কেমন করে যেন সময় ভুলে যায় । কোনদিক দিয়ে যে দুই ঘণ্টা পাড় হয়ে যায় ও বুঝতেই পারেনা । অথচ পড়ানোর কথা ছিল এক ঘণ্টা । অভিভাবকও কিছু বলেনা কারণ পড়াটা ভালভাবেই চলছে । শ্রাবণের মুখে গল্প শুনতে ভালবাসে অথই । শ্রাবণ যখন গল্প বলতে শুরু করে, অথই তখন একদম চুপটি করে তাকিয়ে থাকে শ্রাবণের চোখের দিকে । ওর মায়াবী চোখ কী যেন বলতে চায় শ্রাবণকে । শ্রাবণ বেশিদূর এগুতে পারেনা, অথইয়ের মায়াবী চোখে হারিয়ে যাওয়ার ভয়ে নিজেকে গুটিয়ে নেয় । মুখে বলে, “শুধু গল্প করলেই চলবে?পড়াটা কে পড়ে দেবে? আমি?”
মুহূর্তেই মুচকি এক ঝলক হাসি খেলে যায় অথইয়ের ঠোঁটে । মায়াবী ভঙ্গিতে বলে, “পড়বো তো, আরেকটু শুনেই তারপর পড়বো ।” শ্রাবণের অস্বীকৃতিতে দু’জনে আবার পড়ায় মন দেয় । মুখে পড়ানোর ভান করলেও মনে মনে ঠিকই অথই থাকে শ্রাবণের ।
শ্রাবণ চিন্তায় পড়ে যায় । কি চায় মেয়েটা ওর কাছে? শ্রাবণই বা ওকে এতটা পছন্দ করে কেন? তবে কি সম্পর্কটা গভীর হতে চলেছে? তবে কি...... হঠাৎ বাসের হর্নের শব্দে সম্বিত ফিরে পায় শ্রাবণ । গন্তব্যের খুব কাছাকাছি ও । নামার প্রস্তুতি নেয় । মনে একটা পরম আনন্দ অনুভব করে ও । মুহূর্তের জন্য ও একথা ভুলে যায় যে ও পড়াতে যাচ্ছে । মনে হয় ও যেন খুব আপন কারো কাছে যাচ্ছে, যাকে দেখার জন্য গত ৪টা দিন ওর মনটা ছটফট করেছে...যার ঠোটের কোনায় একটু হাসি দেখতে ওর এতদূর আসা...যাকে আপন করে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা আর না পাওয়ার ভয়ে কাটে শ্রাবণের প্রতিটি মুহূর্ত... মনের সবটুকু আকুলতা নিয়ে অধির আগ্রহে শ্রাবণ অপেক্ষা করে যাকে একটিবার দেখার জন্য......
[চলবে]
-দেব দুলাল গুহ
No comments:
Post a Comment