১
রাত ৩টা বেজে ১২ মিনিট। গভীর রাত। কিন্তু আকাশের চোখে ঘুম নেই। ঘুম না আসাটা এখন আর নতুন কিছু নয়। প্রায় প্রতি রাতেই এভাবে জেগে থাকতে হয় ওর, একা। মাঝে মাঝে মাকেও জাগিয়ে রাখে। বিধবা মা সারাদিনের পরিশ্রম শেষে ছেলের বিছানার পাশে বসে ছেলের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে একসময় ঘুমিয়ে যান। তারপরের সময়টুকু আকাশ একাই জেগে থাকে। ইদানিং ওর খুব বাঁচতে ইচ্ছে হয়। কত কিছু করা বাকি এখনো জীবনে। অথচ জটিল এক ব্যাধি বাসা বেঁধেছে ওর শরীরে। যার নাম ব্লাড ক্যান্সার। ইংরেজিতে যাকে বলে লিউকোমিয়া।
'লিউকোমিয়া'[ শব্দটির সাথে আকাশের পরিচয় সিলেট ওসমানী মেডিক্যালে পড়ার সময়। রক্তের খুব জটিল এক রোগ। ছোট থেকেই সুস্বাস্থ্যের অধিকারী আকাশ কখনও কল্পনাও করেনি, ওর এমন রোগ হতে পারে। কিন্তু, ইন্টার্ন করার সময় একদিন হঠাৎ কেমন দুর্বল বোধ হতে লাগলো। মাথা ঘুরায়। টানা দুদিন এমন হবার পর ডাক্তার দেখানো হলো। তিনি রোগীকে ঢাকা মেডিক্যালে ট্রান্সফার করে দিলেন। সেখানে নানা ধরণের মেডিক্যাল টেস্ট করানোর পর রিপোর্ট দেখে ডাক্তার অভিভাবক ডাকালেন। অভিভাবক বলতে তো আছেন শুধু ওর মা-ই। বাবা তো কবেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন।
আকাশের মা খুবই সাদামাটা সহজ-সরল একজন মহিলা। যক্ষের ধন সন্তান দুটির জন্যই তাঁর বেঁচে থাকা। স্কুলে শিক্ষকতা করে মেয়ে পলির স্কুলের খরচ জুগিয়ে খুব কষ্টে কিছু টাকা ছেলেকে পাঠাতে পারেন। অথচ, ডাক্তার সেদিন তাঁকে ডেকে জানিয়ে দিলেন, যার মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি এতদিন এত কষ্ট সহ্য করেও বেঁচে আছেন, কিছুদিন পর যে ছেলে ডাক্তার হয়ে বের হয়ে ওর বাবার স্বপ্ন পূরণ করে দাতব্য চিকিৎসালয় খুলে বিনামূল্যে গরিবের চিকিৎসা করবে আর তাঁদের সকল কষ্ট ঘুচাবে, তার নাকি আর বেশীদিন বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ক্ষীণ!
২
সেদিন, ডাক্তারের কথা শোনামাত্র জ্ঞান হারিয়েছিলেন কল্পনা বোস। জ্ঞান ফিরলে বিস্তারিত শুনে জানতে পারলেন, তাঁর ছেলের রক্ত ঠিক নেই। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গিয়েছে। বিদেশে নিয়ে যেতে পারলে ভালো হয়, কিন্তু সেই সামর্থ্য তো তাঁদের নেই! আশার কথা, ঢাকা মেডিক্যালেই নতুন ভবনে এখন এই রোগের চিকিৎসা হয়। গ্রামের জমিজমা বিক্রি করে সেখানেই কেবিনে তোলা হলো আকাশকে। আত্মীয়-স্বজনেরা সেভাবে পাশে এসে না দাঁড়ালেও আকাশের বন্ধু-বান্ধব, ছোটভাই বড়ভাইয়েরা যেভাবে পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল, তাতে লড়াকু মনোভাব ফিরে পেয়েছিলেন কল্পনা। ওরাই ক্যাম্পাসে ঘুরে ঘুরে, অনলাইনে যোগাযোগ করে যোগাড় করে ফেললো আরও কিছু টাকা। বাকি টাকা কিস্তিতে দেয়ার সুযোগ মিললো। এরপর বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের বোর্ডের সিদ্ধান্ত মতে কেমোথেরাপি চলছে। চলবে টানা চার মাস। এতে সুস্থ হবার সম্ভাবনা আছে, তবে নিশ্চয়তা নেই। এই সময়টায় আকাশের কাছে ছায়ার মতো পড়ে থাকেন ওর মা। আর থাকে একটি মেয়ে। ওর নাম পাখি।
পাখি মেয়েটার আসল নাম নয়। এটা আকাশের দেয়া নাম। সে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করে এখন ইন্টার্ন করছে। মেয়েটাকে আকাশ প্রচণ্ড ভালোবাসে। জীবনে এই একটা মেয়েকেই ওর ভালো লেগেছে। তবে আজ পর্যন্ত ওরা কেউ কাউকে ছুঁয়ে দেখেনি, নিয়মিত দেখাও করেনা ইচ্ছা করেই। ওদের সম্পর্কটাকে ঠিক প্রেমের সম্পর্ক বলা যায় না, কিন্তু ভালোবাসা আছে।
৩
জীবনে কোনদিন প্রেম-ভালোবাসায় জড়াবে না বলে পণ করেছিলো আকাশ। বাবা মারা যাওয়ার পর মায়ের কষ্টার্জিত অর্থে ডাক্তারি পড়ে আগে মানুষ হওয়া, তারপর ওসব নিয়ে ভাবা যাবে –এই ছিলো ওর ইচ্ছা। অথচ, বিধাতার ইচ্ছে ছিলো ভিন্ন। কেমন না বলে-কয়েই ওর জীবনে একদিন আবির্ভাব ঘটে গেলো পাখির।
আকাশ তখন এমবিবিএস দ্বিতীয় বর্ষে পড়ে। রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে বিছানায় শুয়ে একটি চ্যাটিং ওয়েবসাইটে বন্ধুদের সাথে চ্যাট করা ওর অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলো। সদ্য বাবা হারানোর কষ্ট আর একাকিত্ব ভুলে থাকতে এটা ওর একটা চেষ্টা ছিলো। এক
দিন সেই চ্যাটরুমে ‘অশ্রু সিন্ধু’ নামের একটি আইডির সাথে আলাপচারিতার এক পর্যায়ে হলো বন্ধুত্ব। মেয়েটিও ডাক্তারি পড়ে বিধায় ওর পড়ালেখার খোঁজখবর নিতো, আলাপ হতো ব্যক্তিগত বিষয় নিয়েও। মেয়েটার মিষ্টি কথায় কেমন একটা স্নিগ্ধতা খুঁজে পেলো আকাশ। ওকে ভালো বুঝতো সে। আস্তে আস্তে একটা সময় মেয়েটির প্রতি দুর্বল হয়ে পড়তে থাকলো। প্রতি রাতে একটা নির্দিষ্ট সময় ওর অপেক্ষায় থাকতো আকাশ। না এলে মন খারাপ হতো, নির্ঘুম রাত কাটতো। এভাবে একসময় ফেসবুক আইডি এবং মোবাইল নাম্বার আদান-প্রদান হলো। দুজন আরও কাছাকাছি এলো। আকাশ মেয়েটির নাম রাখলো ‘পাখি’।
পাখির সুন্দর করে বলা কথা শুনে আর ছবি দেখেই আকাশ ওকে ভালোবেসে ফেললো। একদিন বলেও ফেললো সে কথা। কিন্তু পাখি জানালো, আকাশে উড়াল দিতে পাখির সমস্যা একটাই। আর সেটা হলো ধর্ম। পাখি মুসলিম, আর আকাশ হিন্দু। এ সমাজ এই সম্পর্ককে কিছুতেই মেনে নেবে না। অতএব, তাঁদের নাকি দূরে থাকাই ভালো।
অথচ অবুঝের মতো আকাশ বললো, “আমার একাকিত্বের দিনে তুই মানসিক সঙ্গ দিয়েছিস আমাকে। তোকে ছাড়া আমি কিছুই ভাবতে পারি না। এখন ভালোবাসার সম্পর্কটা থাকুক, পরে পরিবারকে ম্যানেজ করে বিয়ে করা যাবে। তখনও যে যার ধর্ম পালন করবো। বলিউডে শাহরুখ-গৌরিকে দেখিস না?”
আকাশ অবাক হয়ে দেখলো, পাখি মেয়েটা আকাশের চেয়েও অনেক বেশি বাস্তববাদী। সে আকাশকে বুঝাতে চেষ্টা করলো। বললো, “ওদের ব্যাপার আর আমাদের ব্যাপার এক না। তোর মা মানবেন? আমার বাবা-মা তো মেনে নেবেই না। এক হয় যদি তুই ধর্ম পরিবর্তন করিস...”
এই শেষের লাইনটি নিয়ে অনেক ভেবেছে আকাশ। ছুটিতে বাড়িতে গিয়ে মায়ের পাশে গিয়ে একদিন সব লজ্জার মাথা খেয়ে মাকে সব খুলেও বলেছে। শুনে মা সরাসরি না করে দিয়েছেন। বলেছেন, “তুই বংশের একমাত্র ছেলে। এমন কাজ ভুলেও করতে যাবি না। তোর ওপর আমার পূর্ণ বিশ্বাস আছে। তবুও যদি কোনদিন এমন কাজ করে বসিস, তবে তুই আমার মরা মুখ দেখবি।”
এরপর আকাশ যা সিদ্ধান্ত নেবার নিয়ে ফেলেছে। সিদ্ধান্তটা এমন যে, মায়ের মনে ব্যাথা দিয়ে সে কিছু করবে না। ওরা দুজন সারাজীবন বন্ধু হয়েই থাকবে। মাঝে মাঝে ফোনে কথা হবে, কদাচিৎ দেখা-সাক্ষাৎও হবে, কিন্তু কেউ কখনও কাউকে আপন করে পেতে চাইবে না। এই ভালোবাসার নাম কি দেয়া যায়? হিন্দু ধর্মে একটা কথা আছে, ফলের আশা ত্যাগ করে যে কর্ম করা হয় তাকে নিষ্কাম কর্ম বলে। তাহলে আকাশদের এই ভালোবাসাকে কি বলা যায়? কামনা-বাসনাহীন ভালোবাসা?
৪
যেদিন আকাশের রোগটা ধরা পড়লো, সেদিন ছিল পাখির অফ ডে। বন্ধু মারফত খবরটা শুনেই হোস্টেল থেকে ছুটে এলো আকাশের কাছে। আকাশ তখন বিছানায় শুয়ে। পাশে কল্পনা। ঘরভর্তি লোকজন। তখনও ওকে কেবিনে তোলা হয়নি। ইচ্ছে করছিল সব বাধা ভুলে দৌড়ে গিয়ে আকাশকে জড়িয়ে ধরে ইচ্ছেমতো কাঁদে। কিন্তু এত লোকজন, বিশেষ করে আকাশের মাকে দেখে সে থেমে গেলো। দরজায় দাঁড়িয়ে নিরবে অশ্রু বিসর্জন করতে লাগলো।
কল্পনা পাখিকে চিনতে ভুল করলেন না। গতবার দূর্গাপূজার সময় আকাশের সাথে ওর বাসায় গিয়ে কল্পনার হাতে তৈরি নারিকেলের লাড্ডু খেয়ে এসেছে সে। মেয়েটি সবদিক দিয়ে লক্ষ্মী। তাঁর ছেলের পছন্দ আছে বলতে হবে। কিন্তু এই পছন্দকে তিনি উৎসাহ দিতে পারেন না। যেমনটি পারেননি মেয়েটির বাবা-মাও। আজ ওকে দেখে এগিয়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে শান্ত করলেন। এরপর সবাইকে নিয়ে বাইরে গেলেন।
আজ গুনে গুনে ১১০ দিন পর আকাশের সাথে দেখা হলো পাখির। দূরে দূরে থেকে ভুলে থাকার চেষ্টা। ধীর পায়ে আকাশের শয্যার পাশে গিয়ে বসলো সে। তারপর শান্ত কন্ঠে বললো, “শয়তান, দূরে আর থাকতে দিলি কই?”
আকাশ ওর দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসতে চেষ্টা করলো। তারপর বললো, “আমি আর বেশিদিন বাঁচবো না শুনে তোকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছিলো রে। এই যে দেখা হয়ে গেলো, এখন মরে গিয়েও শান্তি। যাহ্, তোকে মুক্ত করে দিয়ে গেলাম...”
সাথে সাথেই দুচোখ উপচে জল এলো পাখির। হাত দিয়ে আকাশের মুখ ঢেকে বললো, “ও কথা আর ভুলেও মুখে আনবি না। তোকে এতো সহজে মরতে দিচ্ছি না আমরা।”
এরপর থেকে আকাশকে কেবিনে ভর্তি করানো, ডাক্তারদের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখাসহ সব কাজে কল্পনার পাশে থাকে পাখি। কল্পনা প্রথমে বাধা দিয়েছিলেন ওর কষ্ট হবে বলে। কিন্তু পাখি সেকথা শোনেনি। ওর বাবা-মাও আর আপত্তি করেননি। বন্ধুর অসুখে বন্ধু পাশে থাকবে, এতে বাধা দেবার অধিকার কারো নেই।
৫
এরপর টানা ৪৫ দিন কেমোথেরাপি দেয়া হয়েছে। অথচ উন্নতির কোন লক্ষণ নেই। আকাশের শরীর আরও দুর্বল হয়েছে, চোখের নিচে কালি পড়েছে। খুব কষ্ট হয়। আজকাল স্যালাইনের নল শরীরে ঢুকিয়ে শুয়ে থাকতে আর ভালো লাগে না আকাশের। মা আর পাখির মলিন মুখে জোর করে মেকি হাসি ফোটানোর চেষ্টা দেখেও ভালো লাগে না। টানা পরিশ্রমে মায়ের চেহাড়াও খারাপ হয়ে গেছে। রুমে একা থাকাকালীন সময়ে ডাক্তারি রিপোর্ট দেখে ও বুঝেছে, কিছুতেই কোন উন্নতি হচ্ছে না ওর। শুধু শুধু টাকার শ্রাদ্ধ হচ্ছে। রক্ত যোগাড় করতেও এখন হিমশিম খেতে হচ্ছে। অথচ ছেলেকে কিছুই এসব কিছু বুঝতে দেন না মা। মা কি কখনও ছেলেকে ফেলে দিতে পারে?
অনেক ভেবেচিন্তে আকাশ ঠিক করলো, এই যন্ত্রণা থেকে নিজে মুক্তি পাওয়া এবং বাকিদের মুক্তি দেয়ার একটাই উপায়। খুব কষ্টে পাখিকে একটা চিঠি লিখলো আকাশ। তখন ভোর ৪ টা। চিঠিটা বালিশের নিচে রেখে, স্যালাইনের নল খুলে ফেললো। তারপর পাশের চেয়ারে ঘুমন্ত মাকে শেষবারের মতো প্রণাম করে ধীর পায়ে বাইরে বেরিয়ে এলো। করিডোরে কেউ নেই, নার্স দুজন ঝিমুচ্ছে। খোলা বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে সামনে লাফ দিয়ে নিজেকে সে মুক্ত পাখির মতো উড়িয়ে নিতে চাইলো। শেষবারের মতো চোখের কোণে দুফোঁটা অশ্রু জমলো আকাশের।
তারপরেই সব শেষ। কল্পনা আর ছেলের লাশ দেখার সাহস করে উঠতে পারেননি। শুনেই বাকশক্তি হারিয়ে শয্যাশায়ী হয়েছেন। পাখি খবর পেয়েই ছুটে এসে চিঠিটা পেয়েছে। তাতে লেখা-
“আমার পাখি,
নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না রে। তোদের কষ্ট আর দেখতে পারি না। ওদিকে ভিটা-মাটি-সম্পদ সব যদি আমিই শেষ করে যাই, তবে পলির ভবিষ্যৎ কি হবে? তাই ভাবলাম অনেক হয়েছে, আর নয়। এবার বিদায় নেবার পালা।
তুই পারলে মাকে একটু দেখিস, পলি বড় হলে ওর ভালো দেখে একটা বিয়ে দিস। আর আমাকে ভুলে যাবি নাতো? যত দূরেই থাকি না কেন, আমার আকাশ তোর জন্য সর্বদা উন্মুক্ত থাকবে। ভালোবাসা নিস। দেখা হবে অন্য কোন জন্মে, অন্য কোন জগতে। যেখানে আমাদের দুজনের মাঝে কোন বাঁধাই আর বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে না।
ইতি,
আকাশ।”
-দেব দুলাল গুহ
রাত ৩টা বেজে ১২ মিনিট। গভীর রাত। কিন্তু আকাশের চোখে ঘুম নেই। ঘুম না আসাটা এখন আর নতুন কিছু নয়। প্রায় প্রতি রাতেই এভাবে জেগে থাকতে হয় ওর, একা। মাঝে মাঝে মাকেও জাগিয়ে রাখে। বিধবা মা সারাদিনের পরিশ্রম শেষে ছেলের বিছানার পাশে বসে ছেলের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে একসময় ঘুমিয়ে যান। তারপরের সময়টুকু আকাশ একাই জেগে থাকে। ইদানিং ওর খুব বাঁচতে ইচ্ছে হয়। কত কিছু করা বাকি এখনো জীবনে। অথচ জটিল এক ব্যাধি বাসা বেঁধেছে ওর শরীরে। যার নাম ব্লাড ক্যান্সার। ইংরেজিতে যাকে বলে লিউকোমিয়া।
'লিউকোমিয়া'[ শব্দটির সাথে আকাশের পরিচয় সিলেট ওসমানী মেডিক্যালে পড়ার সময়। রক্তের খুব জটিল এক রোগ। ছোট থেকেই সুস্বাস্থ্যের অধিকারী আকাশ কখনও কল্পনাও করেনি, ওর এমন রোগ হতে পারে। কিন্তু, ইন্টার্ন করার সময় একদিন হঠাৎ কেমন দুর্বল বোধ হতে লাগলো। মাথা ঘুরায়। টানা দুদিন এমন হবার পর ডাক্তার দেখানো হলো। তিনি রোগীকে ঢাকা মেডিক্যালে ট্রান্সফার করে দিলেন। সেখানে নানা ধরণের মেডিক্যাল টেস্ট করানোর পর রিপোর্ট দেখে ডাক্তার অভিভাবক ডাকালেন। অভিভাবক বলতে তো আছেন শুধু ওর মা-ই। বাবা তো কবেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন।
আকাশের মা খুবই সাদামাটা সহজ-সরল একজন মহিলা। যক্ষের ধন সন্তান দুটির জন্যই তাঁর বেঁচে থাকা। স্কুলে শিক্ষকতা করে মেয়ে পলির স্কুলের খরচ জুগিয়ে খুব কষ্টে কিছু টাকা ছেলেকে পাঠাতে পারেন। অথচ, ডাক্তার সেদিন তাঁকে ডেকে জানিয়ে দিলেন, যার মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি এতদিন এত কষ্ট সহ্য করেও বেঁচে আছেন, কিছুদিন পর যে ছেলে ডাক্তার হয়ে বের হয়ে ওর বাবার স্বপ্ন পূরণ করে দাতব্য চিকিৎসালয় খুলে বিনামূল্যে গরিবের চিকিৎসা করবে আর তাঁদের সকল কষ্ট ঘুচাবে, তার নাকি আর বেশীদিন বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ক্ষীণ!
২
সেদিন, ডাক্তারের কথা শোনামাত্র জ্ঞান হারিয়েছিলেন কল্পনা বোস। জ্ঞান ফিরলে বিস্তারিত শুনে জানতে পারলেন, তাঁর ছেলের রক্ত ঠিক নেই। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গিয়েছে। বিদেশে নিয়ে যেতে পারলে ভালো হয়, কিন্তু সেই সামর্থ্য তো তাঁদের নেই! আশার কথা, ঢাকা মেডিক্যালেই নতুন ভবনে এখন এই রোগের চিকিৎসা হয়। গ্রামের জমিজমা বিক্রি করে সেখানেই কেবিনে তোলা হলো আকাশকে। আত্মীয়-স্বজনেরা সেভাবে পাশে এসে না দাঁড়ালেও আকাশের বন্ধু-বান্ধব, ছোটভাই বড়ভাইয়েরা যেভাবে পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল, তাতে লড়াকু মনোভাব ফিরে পেয়েছিলেন কল্পনা। ওরাই ক্যাম্পাসে ঘুরে ঘুরে, অনলাইনে যোগাযোগ করে যোগাড় করে ফেললো আরও কিছু টাকা। বাকি টাকা কিস্তিতে দেয়ার সুযোগ মিললো। এরপর বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের বোর্ডের সিদ্ধান্ত মতে কেমোথেরাপি চলছে। চলবে টানা চার মাস। এতে সুস্থ হবার সম্ভাবনা আছে, তবে নিশ্চয়তা নেই। এই সময়টায় আকাশের কাছে ছায়ার মতো পড়ে থাকেন ওর মা। আর থাকে একটি মেয়ে। ওর নাম পাখি।
পাখি মেয়েটার আসল নাম নয়। এটা আকাশের দেয়া নাম। সে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করে এখন ইন্টার্ন করছে। মেয়েটাকে আকাশ প্রচণ্ড ভালোবাসে। জীবনে এই একটা মেয়েকেই ওর ভালো লেগেছে। তবে আজ পর্যন্ত ওরা কেউ কাউকে ছুঁয়ে দেখেনি, নিয়মিত দেখাও করেনা ইচ্ছা করেই। ওদের সম্পর্কটাকে ঠিক প্রেমের সম্পর্ক বলা যায় না, কিন্তু ভালোবাসা আছে।
৩
জীবনে কোনদিন প্রেম-ভালোবাসায় জড়াবে না বলে পণ করেছিলো আকাশ। বাবা মারা যাওয়ার পর মায়ের কষ্টার্জিত অর্থে ডাক্তারি পড়ে আগে মানুষ হওয়া, তারপর ওসব নিয়ে ভাবা যাবে –এই ছিলো ওর ইচ্ছা। অথচ, বিধাতার ইচ্ছে ছিলো ভিন্ন। কেমন না বলে-কয়েই ওর জীবনে একদিন আবির্ভাব ঘটে গেলো পাখির।
আকাশ তখন এমবিবিএস দ্বিতীয় বর্ষে পড়ে। রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে বিছানায় শুয়ে একটি চ্যাটিং ওয়েবসাইটে বন্ধুদের সাথে চ্যাট করা ওর অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলো। সদ্য বাবা হারানোর কষ্ট আর একাকিত্ব ভুলে থাকতে এটা ওর একটা চেষ্টা ছিলো। এক
দিন সেই চ্যাটরুমে ‘অশ্রু সিন্ধু’ নামের একটি আইডির সাথে আলাপচারিতার এক পর্যায়ে হলো বন্ধুত্ব। মেয়েটিও ডাক্তারি পড়ে বিধায় ওর পড়ালেখার খোঁজখবর নিতো, আলাপ হতো ব্যক্তিগত বিষয় নিয়েও। মেয়েটার মিষ্টি কথায় কেমন একটা স্নিগ্ধতা খুঁজে পেলো আকাশ। ওকে ভালো বুঝতো সে। আস্তে আস্তে একটা সময় মেয়েটির প্রতি দুর্বল হয়ে পড়তে থাকলো। প্রতি রাতে একটা নির্দিষ্ট সময় ওর অপেক্ষায় থাকতো আকাশ। না এলে মন খারাপ হতো, নির্ঘুম রাত কাটতো। এভাবে একসময় ফেসবুক আইডি এবং মোবাইল নাম্বার আদান-প্রদান হলো। দুজন আরও কাছাকাছি এলো। আকাশ মেয়েটির নাম রাখলো ‘পাখি’।
পাখির সুন্দর করে বলা কথা শুনে আর ছবি দেখেই আকাশ ওকে ভালোবেসে ফেললো। একদিন বলেও ফেললো সে কথা। কিন্তু পাখি জানালো, আকাশে উড়াল দিতে পাখির সমস্যা একটাই। আর সেটা হলো ধর্ম। পাখি মুসলিম, আর আকাশ হিন্দু। এ সমাজ এই সম্পর্ককে কিছুতেই মেনে নেবে না। অতএব, তাঁদের নাকি দূরে থাকাই ভালো।
অথচ অবুঝের মতো আকাশ বললো, “আমার একাকিত্বের দিনে তুই মানসিক সঙ্গ দিয়েছিস আমাকে। তোকে ছাড়া আমি কিছুই ভাবতে পারি না। এখন ভালোবাসার সম্পর্কটা থাকুক, পরে পরিবারকে ম্যানেজ করে বিয়ে করা যাবে। তখনও যে যার ধর্ম পালন করবো। বলিউডে শাহরুখ-গৌরিকে দেখিস না?”
আকাশ অবাক হয়ে দেখলো, পাখি মেয়েটা আকাশের চেয়েও অনেক বেশি বাস্তববাদী। সে আকাশকে বুঝাতে চেষ্টা করলো। বললো, “ওদের ব্যাপার আর আমাদের ব্যাপার এক না। তোর মা মানবেন? আমার বাবা-মা তো মেনে নেবেই না। এক হয় যদি তুই ধর্ম পরিবর্তন করিস...”
এই শেষের লাইনটি নিয়ে অনেক ভেবেছে আকাশ। ছুটিতে বাড়িতে গিয়ে মায়ের পাশে গিয়ে একদিন সব লজ্জার মাথা খেয়ে মাকে সব খুলেও বলেছে। শুনে মা সরাসরি না করে দিয়েছেন। বলেছেন, “তুই বংশের একমাত্র ছেলে। এমন কাজ ভুলেও করতে যাবি না। তোর ওপর আমার পূর্ণ বিশ্বাস আছে। তবুও যদি কোনদিন এমন কাজ করে বসিস, তবে তুই আমার মরা মুখ দেখবি।”
এরপর আকাশ যা সিদ্ধান্ত নেবার নিয়ে ফেলেছে। সিদ্ধান্তটা এমন যে, মায়ের মনে ব্যাথা দিয়ে সে কিছু করবে না। ওরা দুজন সারাজীবন বন্ধু হয়েই থাকবে। মাঝে মাঝে ফোনে কথা হবে, কদাচিৎ দেখা-সাক্ষাৎও হবে, কিন্তু কেউ কখনও কাউকে আপন করে পেতে চাইবে না। এই ভালোবাসার নাম কি দেয়া যায়? হিন্দু ধর্মে একটা কথা আছে, ফলের আশা ত্যাগ করে যে কর্ম করা হয় তাকে নিষ্কাম কর্ম বলে। তাহলে আকাশদের এই ভালোবাসাকে কি বলা যায়? কামনা-বাসনাহীন ভালোবাসা?
৪
যেদিন আকাশের রোগটা ধরা পড়লো, সেদিন ছিল পাখির অফ ডে। বন্ধু মারফত খবরটা শুনেই হোস্টেল থেকে ছুটে এলো আকাশের কাছে। আকাশ তখন বিছানায় শুয়ে। পাশে কল্পনা। ঘরভর্তি লোকজন। তখনও ওকে কেবিনে তোলা হয়নি। ইচ্ছে করছিল সব বাধা ভুলে দৌড়ে গিয়ে আকাশকে জড়িয়ে ধরে ইচ্ছেমতো কাঁদে। কিন্তু এত লোকজন, বিশেষ করে আকাশের মাকে দেখে সে থেমে গেলো। দরজায় দাঁড়িয়ে নিরবে অশ্রু বিসর্জন করতে লাগলো।
কল্পনা পাখিকে চিনতে ভুল করলেন না। গতবার দূর্গাপূজার সময় আকাশের সাথে ওর বাসায় গিয়ে কল্পনার হাতে তৈরি নারিকেলের লাড্ডু খেয়ে এসেছে সে। মেয়েটি সবদিক দিয়ে লক্ষ্মী। তাঁর ছেলের পছন্দ আছে বলতে হবে। কিন্তু এই পছন্দকে তিনি উৎসাহ দিতে পারেন না। যেমনটি পারেননি মেয়েটির বাবা-মাও। আজ ওকে দেখে এগিয়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে শান্ত করলেন। এরপর সবাইকে নিয়ে বাইরে গেলেন।
আজ গুনে গুনে ১১০ দিন পর আকাশের সাথে দেখা হলো পাখির। দূরে দূরে থেকে ভুলে থাকার চেষ্টা। ধীর পায়ে আকাশের শয্যার পাশে গিয়ে বসলো সে। তারপর শান্ত কন্ঠে বললো, “শয়তান, দূরে আর থাকতে দিলি কই?”
আকাশ ওর দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসতে চেষ্টা করলো। তারপর বললো, “আমি আর বেশিদিন বাঁচবো না শুনে তোকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছিলো রে। এই যে দেখা হয়ে গেলো, এখন মরে গিয়েও শান্তি। যাহ্, তোকে মুক্ত করে দিয়ে গেলাম...”
সাথে সাথেই দুচোখ উপচে জল এলো পাখির। হাত দিয়ে আকাশের মুখ ঢেকে বললো, “ও কথা আর ভুলেও মুখে আনবি না। তোকে এতো সহজে মরতে দিচ্ছি না আমরা।”
এরপর থেকে আকাশকে কেবিনে ভর্তি করানো, ডাক্তারদের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখাসহ সব কাজে কল্পনার পাশে থাকে পাখি। কল্পনা প্রথমে বাধা দিয়েছিলেন ওর কষ্ট হবে বলে। কিন্তু পাখি সেকথা শোনেনি। ওর বাবা-মাও আর আপত্তি করেননি। বন্ধুর অসুখে বন্ধু পাশে থাকবে, এতে বাধা দেবার অধিকার কারো নেই।
৫
এরপর টানা ৪৫ দিন কেমোথেরাপি দেয়া হয়েছে। অথচ উন্নতির কোন লক্ষণ নেই। আকাশের শরীর আরও দুর্বল হয়েছে, চোখের নিচে কালি পড়েছে। খুব কষ্ট হয়। আজকাল স্যালাইনের নল শরীরে ঢুকিয়ে শুয়ে থাকতে আর ভালো লাগে না আকাশের। মা আর পাখির মলিন মুখে জোর করে মেকি হাসি ফোটানোর চেষ্টা দেখেও ভালো লাগে না। টানা পরিশ্রমে মায়ের চেহাড়াও খারাপ হয়ে গেছে। রুমে একা থাকাকালীন সময়ে ডাক্তারি রিপোর্ট দেখে ও বুঝেছে, কিছুতেই কোন উন্নতি হচ্ছে না ওর। শুধু শুধু টাকার শ্রাদ্ধ হচ্ছে। রক্ত যোগাড় করতেও এখন হিমশিম খেতে হচ্ছে। অথচ ছেলেকে কিছুই এসব কিছু বুঝতে দেন না মা। মা কি কখনও ছেলেকে ফেলে দিতে পারে?
অনেক ভেবেচিন্তে আকাশ ঠিক করলো, এই যন্ত্রণা থেকে নিজে মুক্তি পাওয়া এবং বাকিদের মুক্তি দেয়ার একটাই উপায়। খুব কষ্টে পাখিকে একটা চিঠি লিখলো আকাশ। তখন ভোর ৪ টা। চিঠিটা বালিশের নিচে রেখে, স্যালাইনের নল খুলে ফেললো। তারপর পাশের চেয়ারে ঘুমন্ত মাকে শেষবারের মতো প্রণাম করে ধীর পায়ে বাইরে বেরিয়ে এলো। করিডোরে কেউ নেই, নার্স দুজন ঝিমুচ্ছে। খোলা বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে সামনে লাফ দিয়ে নিজেকে সে মুক্ত পাখির মতো উড়িয়ে নিতে চাইলো। শেষবারের মতো চোখের কোণে দুফোঁটা অশ্রু জমলো আকাশের।
তারপরেই সব শেষ। কল্পনা আর ছেলের লাশ দেখার সাহস করে উঠতে পারেননি। শুনেই বাকশক্তি হারিয়ে শয্যাশায়ী হয়েছেন। পাখি খবর পেয়েই ছুটে এসে চিঠিটা পেয়েছে। তাতে লেখা-
“আমার পাখি,
নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না রে। তোদের কষ্ট আর দেখতে পারি না। ওদিকে ভিটা-মাটি-সম্পদ সব যদি আমিই শেষ করে যাই, তবে পলির ভবিষ্যৎ কি হবে? তাই ভাবলাম অনেক হয়েছে, আর নয়। এবার বিদায় নেবার পালা।
তুই পারলে মাকে একটু দেখিস, পলি বড় হলে ওর ভালো দেখে একটা বিয়ে দিস। আর আমাকে ভুলে যাবি নাতো? যত দূরেই থাকি না কেন, আমার আকাশ তোর জন্য সর্বদা উন্মুক্ত থাকবে। ভালোবাসা নিস। দেখা হবে অন্য কোন জন্মে, অন্য কোন জগতে। যেখানে আমাদের দুজনের মাঝে কোন বাঁধাই আর বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে না।
ইতি,
আকাশ।”
-দেব দুলাল গুহ
No comments:
Post a Comment