খুঁজুন

Friday, January 27, 2017

ফিজিক্স ডিইউ গ্রুপ এবং রাসয়াত রহমান জিকো ভাইয়ের মন্তব্য


সেদিন ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টে একজন সিনিয়র শ্রদ্ধেয় স্যারের কাছ থেকে বিনা কারণে খুবই খারাপ ব্যবহার পেয়ে ফিরে আসার পর মনের কষ্ট থেকে একটি লেখা লিখে ফেসবুকে দেই। লেখাটি ডিপার্টমেন্টের ছাত্র-শিক্ষকদের কমন প্ল্যাটফর্ম 'ফিজিক্স ডিইউ' গ্রুপেও দেই। কাল থেকে সেই পোস্টটি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। খোঁজ নিলে অ্যাডমিনদেরই একজন জানালেন, বিভাগের বড় ভাই বর্তমানে ব্যাংকার ও জনপ্রিয় লেখক রাসায়াত রহমান জিকো ভাই নাকি পোস্টটা ডিলিট দিয়েছেন। গ্রুপের অ্যাডমিন প্যানেলের থেকে এই কথার প্রমাণটাও পাওয়া গেছে। অথচ জিকো ভাইকে খুঁজে বের করে জানতে চাইলে তিনি অস্বীকার করলেন এবং বিশেষ সেই শিক্ষকের সম্পর্কেও গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছেন। তিনি প্রথমে এই ব্যাপারে কিছুই জানেন না বলে মন্তব্য করেন। এমনকি ফেসবুকের গ্রুপ সেটিঙ্গস নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করারও সময় নেই বা খুব একটা জানেন না বলে জানান। পরে এক পর্যায়ে তিনিই আবার গ্রুপে গিয়ে পোস্টটির ডিলিট হিস্টোরিতে গিয়ে 'আনডু' করে পোস্টটি গ্রুপে ফিরিয়ে আনেন। তাঁকে ধন্যবাদ।
যেহেতু সবাই প্রমাণ চায়, তাই বাধ্য হয়ে ইনবক্সের স্ক্রিণশট দিতে হলো। এজন্য আমি সবার নিকট ক্ষমাপ্রার্থী। বিস্তারিত নিচে দেওয়া গেলোঃ

প্রথমদিনের পোস্টের লিংক (Click here)

দ্বিতীয় ও শেষ পোস্টের লিংকঃ (click here) 

Physics DU গ্রুপের অ্যাডমিন লিস্টঃ



জিকো ভাই যে আমার পোস্ট গ্রুপ থেকে মুছে দিয়েছেন, তাঁর প্রমাণঃ 







অতঃপর জনপ্রিয় লেখক ও শ্রদ্ধেয় বড় ভাই জিকো ভাইয়ের বিষয়টি অস্বীকার করা এবং মূল্যবান মন্তব্য প্রদানঃ


 




















Wednesday, January 25, 2017

নাম্বার চাওয়ার প্রতিদানে নিজের বিভাগেই হতে হলো অপমানিত!

নিজের ডিপার্টমেন্ট, যেখানে টানা ৫-৬টি বছর কাটিয়েছি অনেক হাসি-কান্নার স্মৃতি জমিয়ে, সেখানেই আজ চেয়ারম্যান স্যারের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে দেখা পেলাম না, কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর অফিসে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কাছে তাঁর নাম্বার চাইলে পাশে বসে থাকা একজন সিনিয়র শিক্ষক, যিনি বর্তমানে সরকার দলীয় প্রভাবশালী শিক্ষকনেতা, বিনা দোষে আমাকে অকথ্য ভাষায় অপমানিত করে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিলেন! চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে পারলে আমাকে মারেন, এমন অবস্থা! অথচ আমিতো তাঁকে দেখা মাত্রই চেয়ার ছেড়ে উঠে সালাম দিয়ে জানতে চেয়েছিলাম, 'স্যার কেমন আছেন?'

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা বিভাগীয় প্রধানের ফোন নাম্বার চাওয়াটা কি অন্যায়? নাকি এক্স-স্টুডেন্ট হয়ে গেলে আবার কোনো কাজে অথবা নিতান্তই দেখা করে সালাম জানিয়ে আসতে যাওয়াটা অন্যায়ের ভেতর পড়ে?

এই 'শ্রদ্ধেয়' শিক্ষকই ছাত্রাবস্থায় থার্ড ইয়ারে আমাকে একটি টিউশন দিয়েছিলেন, আমি ভুলে যাইনি। ভুলে যাইনি ৬ মাস পড়ানোর পর বেতন বাড়ানোর অনুরোধ করেছি শুনে তাঁর সেই ফোন, সেই বকাঝকা। (অথচ সেই ছাত্র ও তার বাবার সঙ্গে আমার এখনো সুসম্পর্ক আছে।) তারপর সেই বছরই ল্যাব পরীক্ষায় ইচ্ছা করে খারাপ মার্ক দেয়া, ৬৯.৫ মার্ক পেয়েও সেই ৮ ক্রেডিটের কোর্সে মাত্র ০.৫ মার্ক না পাওয়া। সাধারণত কেউ ফ্র‍্যাকশন মার্ক পেলে তা পূরণ করে পূর্ণ নম্বর করে দেয়া হয়। কিন্তু সেটা আমার ক্ষেত্রে হয়নি। কারণ তিনিই ছিলেন কোর্স কো-অর্ডিনেটর! শুধু কি তাই? হলের পলিটিক্যাল গ্রুপ আমাকে সিটের থেকেই নামিয়ে দিল, আমাকে আশ্রয় নিতে হলো অন্য হলে বন্ধুদের সাথে, সেই বছরই! তাঁর সিইডি কোর্সেও কোনোমতে পাশ করেছিলাম! আরও কতকিছু যে মাথায় ঘুড়ে!

সেই ল্যাবের মাত্র ০.৫ মার্কের জন্য মাস্টার্সে আমি থিসিস করতে পারিনি, আমাকে করতে দেয়া হয়নি! পরবর্তীতে তাঁর প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে মিথ্যে কথা লিখতে বলেছিলেন, আমি লিখিনি। হয়তো এসবই আমার দোষ! এজন্যই আজ আমাকে সবার সামনে এভাবে হেয় করা হলো? হায়রে ক্ষমতা, হায়রে ছোটলোকি!
(তাঁর নামের অদ্যাক্ষর 'ই'।)  

#DU_Physics
#Shame

Wednesday, January 18, 2017

ভিন্ন রকমের জন্মদিন আয়োজনের দৃষ্টান্ত



কতো রকমভাবেই তো পালিত হয় জন্মদিন। কেক কেটে মোমবাতি নিভিয়ে যে আয়োজন হয়, সেটাই বেশি প্রচলিত। অথচ খাঁটি বাঙ্গালি উদযাপন কিন্তু এটা নয়। আমরা দিনদিন হারিয়ে ফেলছি বাঙ্গালিয়ানা। আমার মনে পড়ে ছোটবেলার কথা। কারণ, আমার জন্মদিন পালনের বিষয়টাই ছিলো ব্যাতিক্রম, একটি দৃষ্টান্ত। ভালো লাগলে এভাবে জন্মদিন পালন করতে পারেন আপনারাও।
.
১৯ বছর বয়স পর্যন্ত বাবাকে পেয়েছি, প্রতিবারই পালিত হয়েছে আমার জন্মদিন। কিন্তু জন্মদিনে কেক কাটা হোত না কখনই। বাবার মতে ওটা আমাদের সংস্কৃতি নয়। আমার জন্মদিনে তাই আয়োজিত হোত 'শিশুভোজ'। এলাকার সব বাচ্চাদেরকে নিমন্ত্রণ করা হোত তাদের মাসহ। জন্মদিনের নিমন্ত্রণপত্রে আমার নিজের হাতে লেখা থাকতো-- 'লৌকিকতা বর্জনীয়'।
.
জন্মদিনের দিন সবাই আমাদের বাসায় আসতো। কতজন আসতো তার কোন হিসেব থাকতো না। ধারদেনা করে হলেও বাবাকে দেখেছি এই অনুষ্ঠান আয়োজন করতে। বড় বড় পাতিল-কড়াইয়ে রান্না হোত। দূর-দূরান্ত থেকেও মানুষ আসতো। রাস্তা থেকে রিকশায় করে ভিখারী নিয়ে আসতেও দেখেছি বাবাকে। 'লৌকিকতা বর্জনীয়' কথাটা লেখা থাকার পরেও অনেকেই অনেক উপহার নিয়ে আসতো। সেইসব উপহার থেকে শুধু ফুল আর শিক্ষার উপকরণ বাদে বাকি সব উপহার ফিরিয়ে দেয়া হোত। শুধু মানুষের ভালোবাসা, দোয়া/আশীর্বাদ প্রার্থনীয় ছিল।
.
ছোটবেলায় কখনও খারাপ লাগেনি এজন্য। আমার হাতের থেকেও উপহার ফিরিয়ে দেয়া হতো। ওদিকে, সৎপথে চলতো বলে বাবা খুব হিসেবী ছিলো। চাইলেই অনেক কিছু পেতাম না। এমন দামি সব পোষাক, খেলার সামগ্রী ফিরিয়ে দিতে গিয়ে কখনও খারাপ লাগতো না? একদম ছোটবেলায় একটু লাগতো। কিন্তু বাবা খুব সুন্দর করে বুঝাতো, কেন ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে এসব। বাবা বলতো, 'যখনই কেউ দামি উপহার দিয়ে খাবে, তখন সে উপহারের সাথে খাবারের মান মিলিয়ে দেখবে, আর মনে মনে হিসেব মেলাবে- উপহারের টাকাটা উঠে এলো কিনা এই ভেবে। উপহার দিতে না হলে এই হিসেবের বালাঈ থাকবে না, মানুষ শুধু তোমাকে ভালোবাসা দেবে'।
.
একটু বড় হয়েই বাবার নীতি ও আদর্শকে ভালোবাসতে শুরু করলাম, বুঝলাম। এভাবে ধীরে ধীরে বিলাসিতাকে বিদায় দিতে শিখেছিলাম, বাবাকে নিয়ে গর্ব হোত, এখনও হয়। ছোট থেকেই বিলাসিতাকে ত্যাগ করেও কষ্টের মাঝে হাসিমুখে ভালো থেকেছি। জিলা স্কুলে প্রথম সারির ছাত্র ছিলাম। দোচালা টিনের ঘরে গরমে সেদ্ধ হয়ে ঘেমে নেয়ে উঠেও ক্লাস এইটে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছিলাম। স্কুলের কোন স্যারের কাছে পড়ার সুযোগ হয়নি। প্রথম বাসায় স্যার এলেন ক্লাস টেনে, এসএসসিকে সামনে রেখে। আমার জন্য বাবা তার সবকিছুই বাজি রাখতো, সবরকম চেষ্টা থাকতো আমাকে মানুষ করার। অন্যদেএ বলতে শুনেছি, 'আমার সর্বস্ব দিয়ে ওর (মাথার) মধ্যে পুঁজি ভরে দেবো। এরপর ও ঠিকই করে খেতে পারবে, অনেক বড় হবে'।
.
আজ মনে হয়, বাবা সেই সৎপথে মাথা উঁচু করে সংগ্রাম করে বেঁচে থাকার শিক্ষাটা না দিলে, আজ বাবাহীন এই ৯টি বছর মাকে নিয়ে এই দুর্দিনের পৃথিবীতে হয়তো টিকে থাকতে পারতাম না। বাবার প্রতি শ্রদ্ধা জানাই।
.
#কবি_বাবু_ফরিদী 


>> দেব দুলাল গুহ

Tuesday, January 17, 2017

সতের এক্কে সতের



আজকের তারিখটা কিন্তু দারুণ। ১৭-০১-১৭। ১৭ গুণ ১ = ১৭। প্রতিটি ডিজিট যোগ করলেও ১৭ হয় (১+৭+০+১+১+৭ = ১৭)। দারুণ একটা বিষয় 'আবিষ্কার' করলাম তো!

মানুষ যে কেন বড় হয়! বিশেষ করে ছেলেদের বড় হওয়া ঝামেলার। যতই বড় হচ্ছি, ততই বাড়ছে দায়িত্ব, প্রত্যাশার চাপ। পড়ালেখা করো মন দিয়ে, পড়ালেখা শেষে আবার পড় চাকরির পড়া, চাকরি পেলে এবার একটা বিয়ে করো! আর যেই বিয়ের জালে ফেসে গেলে, সেই তোমার ঘাড়ে বাড়তি এক পরিবার। বড় হলেই মানুষের আসল চেহাড়া দেখা যায়!

তবুও তো মানুষ বড় হয়! বড় তো হতেই হয়। ছোট থাকতে চাইলেও সে পারে কই? পারে নাতো! আমিও তো বড় হচ্ছি। চলে গেলো আরও একটি বছর। হতাশা, ব্যার্থতা আর হয়তো কিছু সাফল্যও অর্জন করেছি। কিন্তু আসল কথা হলো, আমি পথ ধরে হাঁটছি। ঠিক না বেঠিক পথ আমি জানি না, শুধু জানি থেমে নেই আমি। আজকালকার দুনিয়ায় সত্য ও সুন্দরের পথে টিকে থাকার চেষ্টাটাই বা কম সাফল্যের কে বললো?

মা একটু আগে ফোন দিলো। দিয়ে মনে করিয়ে দিলো, সেই দিনটাও নাকি মঙ্গলবারই ছিল, বাংলায় ৩ মাঘ, ইংরেজিতে ১৭ জানুয়ারি। ঠিক আজকের মতো অথবা এর চেয়ে বেশি শীত ছিল সেই রাতে। ফরিদপুরের পানি ওয়াপদা (পানি উন্নয়ন বোর্ড) এর নির্মাণ কাজ চলছে। পিছের বাড়িটাই আমাদের ছিল। রাত আনুমানিক ৩টায় মায়ের প্রসব বেদনা উঠলো। রিক্সায় করে হাসপাতালে নেয়ার চেষ্টা সফল হতে দিলাম না আমি। দুনিয়া দেখতে চাই, জলদি, তখনই। রিক্সায় ওঠার আগেই সেই নির্মাণকাজের জন্য এনে রাখা খোয়া বালির মাঝে লাফ দিয়ে পড়লাম। কোনো কান্নাকাটি নাই। মা থেকে আমাকে আলাদা করা হলো। তারপর দাদু তাঁর সাদা খদ্দরের চাদরটা দিয়ে দু-তিনবার আমাকে ঝাঁকি দিতেই, সেই যে কান্না শুরু করলাম, তা আজও নিরবে অথবা সরবে চলছে।

গল্পটা বাবার মুখে শোনা। বাবা বলতো, সেই রাতে আমার নাকি বাঁচারই কথা ছিল না। বেঁচেই যেহেতু গেছি, সেহেতু বাবার মতে আমি 'খুব বড় কিছু হবো', খুব ভালো অথবা খুব খারাপ কিছু। (আমার আগে বাবা-মায়ের এক সন্তান পৃথিবীর আলো দেখেনি। আমি তার প্রতি কৃতজ্ঞ, কারণ সে বেঁচে থাকলে 'পরিবার পরিকল্পনা'মাফিক আমি আর জন্ম নিতাম না!)

কী হচ্ছি বা কী হবো জানিনা, শুধু জানি, এখনও বেঁচে থাকার চেষ্টা করে যাচ্ছি। আবেগ অভিমান হতাশা ঝেরে ফেলে, বাস্তবিক হয়ে সামনে এগিয়ে যেতে চাই। সবার জন্য সুন্দর ও ভালোবাসার রঙে রাঙ্গানো একটা পৃথিবী গড়তে চাই।

Monday, January 16, 2017

নোবেলজয়ী বব ডিল্যানের গানের অনুবাদ: 'আছে সবার জানা' / দেব দুলাল গুহ




অনূদিত গানঃ আছে সবার জানা
অনুবাদঃ দেব দুলাল গুহ / দেবু ফরিদী

কতোটা পথ হাঁটলে তাকে মানুষ বলা যায়?
কতো সমুদ্র পেরিয়ে তবে পায়রাটা ঘুমায়?
ক'বার উড়লে কামান-গোলা,
বাতিল তারে যায় বলা?
উত্তরটা, বন্ধু আমার, আছে সবার জানা।।

কতো বছর বাঁচে পাহাড় সাগরে মেশার আগে?
ক'বছর কেউ বাঁচে বলো মুক্তি পাওয়ার আগে?
ক'বার দেখেও না দেখার ছলনায়,
মুখ লুকিয়ে পালিয়ে সে বেড়ায়?
উত্তরটা, বন্ধু আমার, আছে সবার জানা।।

ক'বারের প্রচেষ্টায় কেউ আকাশ দেখতে পায়?
কতটা কান পাতলে মানুষের কান্না শোনা যায়?
কত অগুনিত মানুষ মরলে পরে,
বুঝবে লাশের মিছিল গেছে বেড়ে?
উত্তরটা, বন্ধু আমার, আছে সবার জানা।।
................................................................
মূল গানঃ Blowing In The Wind
গীতিকারঃ Bob Dylan

How many roads must a man walk down
Before you call him a man ?
How many seas must a white dove sail
Before she sleeps in the sand ?
Yes, how many times must the cannon balls fly
Before they're forever banned ?
The answer my friend is blowin' in the wind
The answer is blowin' in the wind.

Yes, how many years can a mountain exist
Before it's washed to the sea ?
Yes, how many years can some people exist
Before they're allowed to be free ?
Yes, how many times can a man turn his head
Pretending he just doesn't see ?
The answer my friend is blowin' in the wind
The answer is blowin' in the wind.

Yes, how many times must a man look up
Before he can see the sky ?
Yes, how many ears must one man have
Before he can hear people cry ?
Yes, how many deaths will it take till he knows
That too many people have died ?
The answer my friend is blowin' in the wind
The answer is blowin' in the wind.

Sunday, January 15, 2017

কবিতা: তোমার আঁচলখানি দেবে?



তোমার হাতটা দেবে?
ছুঁয়ে শিহরণ নেব ।

বিনিদ্র রজনীগুলো কাটিয়েছি একা জেগে;
কত অজস্র বেদনার জ্বালা সয়ে,
অপেক্ষায় থেকেছি শুধু একটি ভোরের!

এখন ভোরের আলোতে
আমি ক্লান্ত, তৃষ্ণার্ত প্রাণ--
মিষ্টি রোদ আমার ভালো লাগে না,
পাখির কলকাকলি আমায় টানে না।
এত আলো দিয়ে করবো কি আমি?
কেন উঠলো হতচ্ছাড়া সূর্যটা?
ঘুমিয়ে থাকলে কি এমন ক্ষতি হতো ওর?

বিরক্ত চোখে তাকাই সূর্যের দিকে
আধবোজা চোখে পিট পিট করে;
রাতের আধারই ভালো ছিল বেশ
কেমন শান্ত আর নীরব ছিল!

ভোর মানেই তো নতুন দিন
ব্যস্ততা আর নতুন কিছু দায়িত্ব,
কাজ হাতে নিয়ে দৌড়ে বেড়ানো
আমার ভালো লাগে না!

তোমার আচলখানি দেবে?
কপালের ঘাম মুছে, দেবে কোলখানি?
কতরাত ঘুমাই না আমি,
কত অজস্র জ্বালা গেছি সয়ে!

- দেব দুলাল গুহ (দেবু ফরিদী) 
২১/১১/২০১২ 
(ভোর ৭ টা)

নতুন বছরে যা চাই আমি


 ফরিদপুর শহরের অদূরে গোয়ালচামট গ্রামের শ্রীঅঙ্গন মন্দিরের জলার সিঁড়ির ওপর বছর দশেক ধরে আশ্রয় নিয়েছেন এক মহিলা। তাঁর এক হাত নেই। ডান হাত দিয়েই খান এবং বাকি কাজ সারেন। এই বৃদ্ধা গত ১০টি বছর ধরে রোদ-বৃষ্টি-শীতের মাঝে ঐ একটু জায়গাতেই শুয়ে বসে কাটিয়ে দিচ্ছেন দিনরাত। মাঝে শুধু টয়লেট করতে হলে খুব কষ্টে নিচে নেমে ঝোপের আড়ালে যান। এই মহিলাকে অনিয়মিতভাবে দিনে তিনবেলা কোনোরকম ধরণের এক খাবার দেওয়া হয় মন্দির থেকে। গায়ে পড়ার ম্যাক্সি, অল্প ওমের কম্বলটা এবং মাঝে মাঝে মশা তাড়ানোর কয়েল দেয় এলাকাবাসীদের কেউ কেউ। অবাক করা বিষয়ই বটে। আরও অবাক করা বিষয় হলো, বৃদ্ধা যেখানে বসে থাকেন বা ঘুমান, সেই অল্প জায়গাটুকুতে পাশ ফিরতে গেলেই দোতলা সমান উচ্চতা থেকে নিচে মাটিতে পড়ে যাবার সম্ভাবনা। কিন্তু বৃদ্ধা কখনও পড়ে যান না। কেউ কেউ বলে তিনি পাগল। আবার অনেকেই বলেন, স্বামী মারা যাওয়ার পর এই মহিলা ও তাঁর ছেলেকে স্বামীর সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করে তাঁর শরিকরা। সেই থেকেই তাদের ওপর অভিমান এবং ক্ষোভ থেকে এখানে এই মন্দিরে আশ্রয় নেন তিনি, হন স্রষ্টার অবতারের স্মরণাপন্ন। কিন্তু সাধুরা ভেতরে বেশিদিন থাকতে না দিলে বাইরেই সিঁড়ির পাশে আশ্রয় নেন। এই মহিলা আজও সুবিচার পাননি। বৃষ্টিতে ভিজে তাঁকে আমি জ্বরে কাঁপতে দেখেছি, শীতেও তিনি কাঁপেন ঠান্ডায়। কিন্তু কেউ নিতে এলে যান না। অন্য কারো বাসাতেও তিনি অতিথি হয়ে যান না। ওখানে বসেই এক ধ্যানে ঈশ্বরের কাছে বিচার চেয়ে চলেছেন আজও!

*
খুব অল্প বয়সেই পরিবার ছাড়া হতে হয়েছিলো লতাকে। বাবা-মা এবং সাত ভাইবোনের অভাব-অনটনের সংসারে ঠাই হয়নি ওর। জন্ম নিয়েই দেখেছে বাবা-মায়ের মলিন মুখ। কন্যাসন্তান জন্ম নিলে অধিকাংশ বাঙ্গালি বাবা-মায়ের মুখ যেমনটি হয় আর কি। তারপর একটু বড় হলে, একদিন ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার নাম করে নিজেদের পরিচিত বস্তি ছেড়ে শাহবাগ ভার্সিটি এলাকায় ওকে রেখে যায় ওর বাবা। তারপর অনেক কেঁদেছে ও, বাবা-মাকে খুঁজেছে রাস্তায় রাস্তায়। শেষে তাদের কাউকেই না পেয়ে, লতা পাকাপাকিভাবে আশ্রয় নিয়েছে এই ক্যাম্পাস এলাকাতেই। এখানেই ফুটপাথে বসে এক খালার কাছে ফুল দিয়ে মালা বানানো শিখে নিয়েছে। শাহবাগের ফুলের দোকান থেকে সস্তায় দুই একদিনের বাসি ফুল কিনে নিয়ে মালা গেঁথে বিক্রি করেই পেট চলে এখানকার ফুটপাথের মেয়ে-মহিলাদের। লতারও তাই, মালা বিক্রির টাকাতেই পেট চলে। রাতে খালার পাশেই অন্য সবার সাথে এক হয়ে শুয়ে পড়ে ও। ক্যাম্পাসের ছেলেমেয়েদেরকে ব্যাগ কাঁধে ক্লাসে যেতে দেখে ওরও ইচ্ছা হয় স্কুলে যাবে। কিন্তু খালা কড়া ভাষায় বলে দিয়েছে, পড়ালেখার নাম নেয়াও নাকি ওর জন্য পাপ।

অন্য দিনের মতো, আজকের দিনেও রজনীগন্ধ্যার মালা হাতে লতা দাঁড়িয়ে আছে শাহবাগ মোড়ের বিশাল স্ক্রিনগুলোর নিচে। সিগন্যাল পড়তেই, চকচকে প্রাইভেট কারগুলোকে টার্গেট করে এগিয়ে গেলো ও। তিনটা গাড়ির গ্লাসই খুললো না। গ্লাস খুললো লাল টয়োটা গাড়িটা থেকে এক মহিলা।
-আপা, নিবেন? মাত্র ১০ ট্যাকা।
-কিরে, তোর ফুল এতো নরম ক্যান? বাসি ফুল নিয়ে আসছিস বিক্রি করতে?
-কই আফা, এক্কেবারে তাজা। কেবল মালা গাইত্থা আনলাম...
-এহ, আসছে! দুইটা ১০ টাকায় দিবি?
-এইডা কী কন আফা! আফনেরা এমুন করলে বাচুম ক্যামনে?

গ্লাসটা আবার উঠে গেলো। ভেতর থেকে স্পষ্ট শোনা গেলো দুটি শব্দ-- 'ফকিন্নির বাচ্চা!'

*এইচএসসি পাশের পর হঠাৎ করেই বাবাকে হারিয়ে বসে অনুপ। বাবাকে ছাড়া ও এবং ওর মা কখনই কিছু বুঝতো না। দুজনই সহজ-সরল, তাই বাবার মৃত্যুর পর গোটা দুনিয়াটাই যেন পাল্টে গেলো। শ্রাদ্ধ-শান্তির পর আত্মীয়রাও যার যার বাড়ি চলে গেলো। মায়ের কপালে সিঁদুর নেই, গায়ে সাদা কাপড় দেখে শুধুই কান্না পায় অনুপের। আর মনে পড়ে বাবার স্মৃতি। কাঁদতে কাঁদতেই পড়ে মাসখানেক পর ঢাকার ভালো একটা ভার্সিটিতে চান্স পেয়ে যায় সে। কিন্তু মন সায় দেয় না। মাকে একা এই ময়মনসিংহে রেখে ও কী করে ঢাকা যায়? তার চেয়ে আনন্দমোহনই ভালো। মায়ের পাশে থাকা যাবে। কিন্তু বাধ সাধে বড় হবার প্রচন্ড ইচ্ছা। ছোট থেকেই ভালো ছাত্র অনুপ, এভাবেই থেমে যাবে? মাকে রাজি করিয়ে সে পাড়ি জমায় ঢাকার উদ্দেশ্যে।

ঢাকায় গিয়ে খুব কষ্টে রাজনীতি করার শর্তে ভার্সিটির হলে সিট পায় সে। আর পেট চলে টিউশন করে। সাথে পত্রিকায় লেখালেখি ও সম্পাদনায় সহযোগিতা করেও কিছু পায়। কিন্তু এভাবে সৎভাবে চলতে কষ্ট হলেও সে পথভ্রষ্ট হতে পারে না। এভাবেই খুব কঠিন এক বিষয়ে অনার্স করেই ফেললো সে কষ্টেমষ্টে। রেজাল্টও মোটামুটি ভালোই হলো। কিন্তু যেখানে ওর কাজ করার ইচ্ছা, সেখানে ওর যোগ্যতার মূল্যায়ন হলো না। ওর মনেও জেদ, অন্য কোথাও সে যাবে না। ডাক এলেও দেয় ফিরিয়ে। লোকে তাকে পাগল বলে, ও নাকি বাস্তবজ্ঞান রাখে না, কল্পনায় চলে। এভাবেই কেটে যায় বছরের পর বছর। হতাশার মেঘ ঘন থেকে ঘনতর হয়। সময় বয়ে চলে। প্রেয়সী হাত চলে যায় অন্যের হাতে। কিন্তু অনুপের ভাগ্য খোলে না।

ওদিকে অনুপের মায়ের দিন কাটে ছেলের পথ চেয়ে। ছেলে কবে চাকরি পাবে, আর কবে তাঁকে নিয়ে একসাথে থাকবে, কবে ছেলের একটা বৌমা আনবে! চার দেয়ালের মাঝে এভাবে রাতের পর রাত একা থাকতে, একা বাজার করে এনে এই বয়সেও একা খেতে আর তাঁর একদমই ভালো লাগে না। তবুও তাঁকে থাকতে হয়। নতুন বছরের প্রথম বছরে ছেলের ফোন এলে, তিনি চোখের জল মুছে হাসি হাসি কণ্ঠে ছেলেকে নতুন বছরের জন্য প্রাণখুলে দোয়া করেন।

*
উপরে যে মানুষগুলোর গল্প শুনলেন, তাঁরা এই সমাজেই বাস করেন। ঘটনা কোনোটাই বাস্তব ঘটনা নয়, আবার সবগুলোই বাস্তব। এই মানুষগুলোর কাছে থার্টি ফার্স্ট নাইটের আকাশভরা দামি দামি আতশবাজি কিংবা ফানুশের কোনো অর্থ নেই। এদের কাছে নতুন বছরের নতুন সকালের মানে নতুন কিছু নয়, আর দশটা সাধারণ মানুষের মতই আরও একটা দিনের শুরু, যে দিনটি বাঁচার জন্য তাঁকে অনেক সংগ্রাম করতে হয়। এই মানুষগুলোর কাছে নতুন বছরটি কিছুটা হলেও আনন্দের বার্তা নিয়ে আসুক। চোখের জল মুছে যাক ঠোঁটের প্রাণবন্ত হাসিতে।

-দেব দুলাল গুহ

Saturday, January 14, 2017

"অথই শ্রাবণ" (আমার লেখা প্রথম ভালবাসার গল্প)



ঘড়ির কাটা জানিয়ে দিল বিকেল সাড়ে পাঁচটা বাজে । তার মানে হাতে আর সময় নেই । ঘণ্টা বাজার সাথে সাথেই স্যাররা খাতা তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন । শ্রাবণের পরীক্ষা অনেক আগেই শেষ । প্রস্তুতি খুব একটা ভালো না, তাই যতটুকু উত্তর জানা ছিল লিখতে তেমন একটা সময় ওর লেগেনি । তবুও বসে থাকা- শেষ মুহূর্তে যদি কোন প্রশ্নের উত্তর মাথায় আসে এই আশায় । ও আজ পরীক্ষা হলে এসেছে দেরি করে,তাও প্রবেশপত্র ছাড়া!

ভাগ্যিস ওকে সব স্যারেরা ভালো করে চেনেন এবং খুব স্নেহ করেন তাই সমস্যায় পড়তে হয়নি, দু-চারটে বকুনির ওপর দিয়েই গেছে । তফাজ্জল স্যার তো বলেই ফেললেন, “তুমি এখানেও লেট?!” শ্রাবণ একটু লজ্জিত হাসি হেসে নিজের আসনের দিকে এগিয়ে যায় । পরীক্ষা দেয় আর বসে বসে অনেক কিছু ভাবে । এই কাজটা বিনামূল্যে করতে পারা যায়, তো ভাবতে দোষ কি?

শ্রাবণ ভেবে যায় । ওর মতে, জীবিত অবস্থায় একমাত্র পরীক্ষা হলেই মানুষ বুঝতে পারে সে কতটা একা । তাও যদি হয় কার্জন হলের মতো জায়গায়, যেখানে দেখাদেখি করার বিন্দুমাত্র সুযোগ নেই । তিনতলা হলরুমটির মাঝখানে অনেকটা শপিং মলের মতো- ফাঁপা, দুইদিকে দরজা । উপরে দাঁড়িয়ে নিচের সব দেখা যায় । সামনের স্যারদের বসার জায়গাটাও অনেক উঁচু, ঐ পাটাতনে বসে পুরো হলরুমে কে কি করছে সব দেখা যায় । পরীক্ষার্থীদের বসার ব্যবস্থা আলাদা আলাদা ডেস্কে, একটা ডেস্ক থেকে আরেকটির দূরত্ব কমপক্ষে একহাত । সাথে স্যারদের কড়া গার্ড তো আছেই । শ্রাবণের এসবে মাথা ব্যাথা নেই । ও ছোট থেকেই একা একা পরীক্ষা দিতে অভ্যস্ত । ছোটবেলায় ভালো ছাত্র ছিল, তাই একা একাই ভালো পরীক্ষা দিত; আর এখনও একা একাই দেয়- শুধু রেজাল্টটা ভালো হয়না । না পড়লে পরীক্ষা ভালো হবে কি করে ?

ইশতিয়াক স্যার এসে শ্রাবণের খাতাটা নিয়ে গেলেন । আশেপাশে তাকাল শ্রাবণ । ভালো ছাত্র বন্ধুরা সব মুখ কাল করে হল থেকে বের হচ্ছে, আর যারা শ্রাবণের মতো বা তার চেয়েও খারাপ ছাত্র তাদের মুখে হাসি । চিন্তা না থাকলে যা হয় আরকি । ভাবটা এমন যে পাস করলেই হয়, আর পাশের মতো পরীক্ষা ওরা দিয়ে ফেলেছে । শ্রাবণ হাসেনা । মুখ কালো করেও থাকেনা । এই মুহূর্তে ওর প্রচণ্ড পরিশ্রান্ত লাগছে । সাথে যোগ হয়েছে রাত জাগার ক্লান্তি ।

“টানা ৪ ঘণ্টা পরীক্ষা দেয় মানুষ?” -ভেতরে ভেতরে এই ডিপার্টমেন্টে ভর্তি হওয়ার জন্য নিজেকে গালি দেয় ও । তালা হাতে মামার তাড়া খেয়ে ধীর পায়ে হল থেকে বেরোয় । বন্ধুদেরকে একসাথে আড্ডা মারতে দ্যাখে ও । যথারীতি পরীক্ষার আলাপ । কার কেমন হল... কোন প্রশ্নের উত্তর কত...প্রশ্ন কেমন হয়েছে- সোজা না কঠিন -এসব নিয়েই আলোচনা । শ্রাবণ কিছুক্ষণ ওখানে দাঁড়ায় । বন্ধু-বান্ধবিরা কেউ কেউ জানতে চায় ওর পরীক্ষা কেমন হল । কোন উত্তর না দেয়াটাই সমীচীন মনে হয় ওর কাছে । “ভালো ছাত্রদের কাছে নিজের পরীক্ষা খারাপ দেয়ার কথা বলে লাভ কি? করুণা আর দু-একটা সান্ত্বনা বাক্য ছাড়া কিছু জুটবে?”- ও ভাবে । শার্টের বোতাম আরেকটা খুলে দিয়ে উদাস মনে হাঁটতে থাকে শ্রাবণ । মোবাইলের হেডফোনটা কতদিন ধরে বিকল হয়ে পড়ে আছে, তাই পছন্দের গানগুলাও মোবাইলে শোনার সুযোগ নেই । হাঁটতে হাঁটতে মাঠের মাঝে এসে দাঁড়ায় ও । কার্জনের অপরূপ প্রকৃতি এই মুহূর্তে ওকে একদমই টানছে না । কিছুই ভালো লাগছেনা ওর । মাথাটাও ঝিমঝিম করছে ।

হঠাৎ পকেটের ভেতর কি যেন একটা কেঁপে উঠলো । হাত দিয়ে মোবাইলটা চোখের সামনে ধরতেই ওর চোখজোড়া চকচক করতে লাগলো । মুহূর্তেই সব ক্লান্তি, সব অবসাদ কোথায় যেন হারিয়ে গেল । যেন কোন এক আলাদীনের চ্যারাগ পেয়েছে ও, যা ওর মনকে মুহূর্তে ভালো করে দিয়েছে । আর সময় নষ্ট করেনা ও । দ্রুত হলের দিকে এগোয় । রুমে পৌঁছতে মোবাইলের পর্দায় আরও একটি কাজ ভেসে ওঠে, যা করা ওর জন্য খুবই জরুরী । শ্রাবণ ঘড়ি দ্যাখে, সময় হিসেব করে । “নাহ, কাল করবো । আজ থাক ।”- ভেবেই কাজ ফেলে বাসের জন্য ছোটে ।

হলের পুকুর পাড়ে পৌঁছতেই শ্রাবণের পেটটা চোঁ-চোঁ করে ওঠে । হঠাৎ মনে পড়ে ওর আজ দুপুরে কিছুই খাওয়া হয়নি পরীক্ষার চিন্তায় । কিন্তু খেতে গেলে দেরি হয়ে যাবে এই ভেবে ও খাওয়ার চিন্তা বাদ দেয় ।
বুলেটের দোকান থেকে রুবেল হাঁক দেয়, “দোস্ত পরীক্ষা কেমন দিলি?” -“দিলাম আর কি। তাড়া আছে রে যাই । পরে কথা হবে ।”- বলে অল্প কথায় বিদায় নেয় শ্রাবণ । মনের পর্দায় ভেসে ওঠে অথই এর মুখ । ঠিক ৪ দিন আগে ও বলেছিল আজ যেতে । হাতে একদম সময় নেই । তাই ওর এত তাড়াহুড়া ।

অথই শ্রাবণের নতুন ছাত্রী । ক্লাস নাইনে পড়ে । শ্রাবণ ওকে মাত্র দেড় মাস ধরে পড়ায় । এরই মাঝে অথইকে শ্রাবণের অল্প অল্প করে ভালো লাগতে শুরু করেছে । অথইয়ের নীরব সম্মতি, সেজে গুজে পড়তে আসা, খোঁজ-খবর নেয়া, মিষ্টি হাসির মায়া আর মায়াকরা চোখের চাহনি- এসবই শ্রাবণকে এই ভালো লাগায় উৎসাহ দিয়েছে । শ্রাবণ বাসে ওঠে । ঠেলাঠেলি করে একটু জায়গা করে দাঁড়ায় । খুব বেশি দূরের পথ না । কিন্তু জ্যামটা খুব ভোগায় ।

জ্যামে দাঁড়িয়ে শ্রাবণের মনে পড়ে যায় সেই দিনটির কথা, যেদিন অথইয়ের সাথে শ্রাবণের প্রথম দেখা । শ্রাবণ বরাবরই রাত জাগে আর দিনে ঘুমায় । ওইদিনও তাই করছিল । রুমমেট ঘুম থেকে ডেকে তুলল । প্রথমে পাত্তা না দিলেও “টিউশনি” শব্দটি কানে ঢুকতেই আর ঘুমিয়ে থাকতে পারলনা ও । বহুদিন ধরে টিউশনি নেই, হাত খালি । ৫ মিনিটে আড়মোড়া ভেঙ্গে উঠে ভালো করে খবর নিয়ে বাইরে বেরুল ও । অনেকদিনের অনিয়মে চেহারার অবস্থা খারাপ । এ অবস্থায় কোন ভদ্রলোকের বাড়িতে যাওয়াটা ভালো দেখায় না । তাছাড়া নতুন টিউশনি বলে কথা । এমন এলোমেলো অবস্থায় দেখলে অভিভাবক টিউশনিতে নাও রাখতে পারে । সেলুনে গিয়ে তড়িঘড়ি করে নিজেকে কিছুটা গুছিয়ে নিয়েই রওনা হয় ও ।

পরিচিতিমূলক পর্বে অথই এর পরিবারের সবার সাথে অনেকক্ষণ কথা হয় ওর, সবাই ওকে খুব আপন করে নেয় প্রথম দিনেই । অথই পুরো সময়টা সোফার পিছে শ্রাবণের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে শ্রাবণকে দেখেছে, আর মনে মনে ওজন মেপেছে । ওর সম্মতি নিয়েই ওর বাবা-মা পাকা কথা দিয়েছেন । শেষে ছাত্রীর সাথে শিক্ষককে পরিচয় করিয়ে দেয়া হল । শ্রাবণ এই প্রথমবার অথইয়ের দিকে ভালোভাবে তাকাল । কিন্তু বেশীক্ষণ তাকাতে পারলনা ও । অন্য দিকে চোখ সরিয়ে শুধু মুখে বলল, “হাই!” এই তাকিয়ে না থাকতে পারার পিছে শুধু অথইয়ের মায়াবী সৌন্দর্যই একমাত্র কারণ ছিলনা- আরও কিছু ছিল; যা শ্রাবণ এখন বোঝে ।

প্রথম প্রথম শ্রাবণ অথইয়ের দিকে একেবারেই তাকাতে পারতো না । অসম্ভব সুন্দর একটি মেয়ে ওর পাশে বসে গণিত করবে, আর তার ভাষাময় অসম্ভব সুন্দর চোখদুটোর দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিকভাবে কথা বলে যাবে এতটা পুরুষ হয়ে উঠতে পারেনি তখনও শ্রাবণ । আস্তে আস্তে প্রয়োজনের তাগিদেই চোখা-চোখি, একে অন্যকে বোঝার চেষ্টা শুরু হল । ছাত্রী-শিক্ষকের মাঝে ভালো বোঝাপড়া না থাকলে পাঠদান ফলপ্রসূ হয়না, বোঝার ঘাটতি থাকে- এই ধারণাই শুরুতে ওদেরকে কাছে আনল । আস্তে আস্তে হাসাহাসির সাথে মান-অভিমানের পালাও শুরু হল । প্রতিদিন পরিয়ে ফেরার পথে শ্রাবণের কেন জানি খুব খারাপ লাগে, বুকের ভেতর কথায় যেন চিনচিন ব্যাথা অনুভব করে ও ।

শ্রাবণ অথইকে নিয়ে চিন্তায় পড়ে যায় । ওকে কোনদিন অথই “ভাইয়া” বা “স্যার” বলে ডাকেনি । বিষয়টি শ্রাবণকে ভাবায় । পারত পক্ষে “আপনি” বলে সম্বোধন করা থেকেও বিরত থাকে ও । শ্রাবণ এর পরিণতি ভেবে শঙ্কিত হয়,মনকে শাসায় নিজেই,
“ও ছোট । ও ভুল করলেও আমি করবোনা । আমার ওর থেকে দূরত্ব রেখে চলতে হবে । তাছাড়া ধর্মের বিশাল বাধা তো আছেই ।”

কোনদিন শ্রাবণের আসতে দেড়ি হলে অথইয়ের মুখে রাজ্যের অভিমানের মেঘ ভড় করে । ওর চোখের ভাষা বুঝতে পেরে শ্রাবণের মুখটাও কাল হয়ে যায় । মাথাটা নিচু করে ও বলে, “সরি, আর হবেনা । ” অথইকে পড়াতে আসলে শ্রাবণ কেমন করে যেন সময় ভুলে যায় । কোনদিক দিয়ে যে দুই ঘণ্টা পাড় হয়ে যায় ও বুঝতেই পারেনা । অথচ পড়ানোর কথা ছিল এক ঘণ্টা । অভিভাবকও কিছু বলেনা কারণ পড়াটা ভালভাবেই চলছে । শ্রাবণের মুখে গল্প শুনতে ভালবাসে অথই । শ্রাবণ যখন গল্প বলতে শুরু করে, অথই তখন একদম চুপটি করে তাকিয়ে থাকে শ্রাবণের চোখের দিকে । ওর মায়াবী চোখ কী যেন বলতে চায় শ্রাবণকে । শ্রাবণ বেশিদূর এগুতে পারেনা, অথইয়ের মায়াবী চোখে হারিয়ে যাওয়ার ভয়ে নিজেকে গুটিয়ে নেয় । মুখে বলে, “শুধু গল্প করলেই চলবে?পড়াটা কে পড়ে দেবে? আমি?”

মুহূর্তেই মুচকি এক ঝলক হাসি খেলে যায় অথইয়ের ঠোঁটে । মায়াবী ভঙ্গিতে বলে, “পড়বো তো, আরেকটু শুনেই তারপর পড়বো ।” শ্রাবণের অস্বীকৃতিতে দু’জনে আবার পড়ায় মন দেয় । মুখে পড়ানোর ভান করলেও মনে মনে ঠিকই অথই থাকে শ্রাবণের ।

শ্রাবণ চিন্তায় পড়ে যায় । কি চায় মেয়েটা ওর কাছে? শ্রাবণই বা ওকে এতটা পছন্দ করে কেন? তবে কি সম্পর্কটা গভীর হতে চলেছে? তবে কি...... হঠাৎ বাসের হর্নের শব্দে সম্বিত ফিরে পায় শ্রাবণ । গন্তব্যের খুব কাছাকাছি ও । নামার প্রস্তুতি নেয় । মনে একটা পরম আনন্দ অনুভব করে ও । মুহূর্তের জন্য ও একথা ভুলে যায় যে ও পড়াতে যাচ্ছে । মনে হয় ও যেন খুব আপন কারো কাছে যাচ্ছে, যাকে দেখার জন্য গত ৪টা দিন ওর মনটা ছটফট করেছে...যার ঠোটের কোনায় একটু হাসি দেখতে ওর এতদূর আসা...যাকে আপন করে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা আর না পাওয়ার ভয়ে কাটে শ্রাবণের প্রতিটি মুহূর্ত... মনের সবটুকু আকুলতা নিয়ে অধির আগ্রহে শ্রাবণ অপেক্ষা করে যাকে একটিবার দেখার জন্য......                            
                                                                                                                                                                   [চলবে]

-দেব দুলাল গুহ

ভালোবাসার গল্প: যে আকাশে উড়তে নেই বাঁধা


রাত ৩টা বেজে ১২ মিনিট। গভীর রাত। কিন্তু আকাশের চোখে ঘুম নেই। ঘুম না আসাটা এখন আর নতুন কিছু নয়। প্রায় প্রতি রাতেই এভাবে জেগে থাকতে হয় ওর, একা। মাঝে মাঝে মাকেও জাগিয়ে রাখে। বিধবা মা সারাদিনের পরিশ্রম শেষে ছেলের বিছানার পাশে বসে ছেলের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে একসময় ঘুমিয়ে যান। তারপরের সময়টুকু আকাশ একাই জেগে থাকে। ইদানিং ওর খুব বাঁচতে ইচ্ছে হয়। কত কিছু করা বাকি এখনো জীবনে। অথচ জটিল এক ব্যাধি বাসা বেঁধেছে ওর শরীরে। যার নাম ব্লাড ক্যান্সার। ইংরেজিতে যাকে বলে লিউকোমিয়া।

'লিউকোমিয়া'[ শব্দটির সাথে আকাশের পরিচয় সিলেট ওসমানী মেডিক্যালে পড়ার সময়। রক্তের খুব জটিল এক রোগ। ছোট থেকেই সুস্বাস্থ্যের অধিকারী আকাশ কখনও কল্পনাও করেনি, ওর এমন রোগ হতে পারে। কিন্তু, ইন্টার্ন করার সময় একদিন হঠাৎ কেমন দুর্বল বোধ হতে লাগলো। মাথা ঘুরায়। টানা দুদিন এমন হবার পর ডাক্তার দেখানো হলো। তিনি রোগীকে ঢাকা মেডিক্যালে ট্রান্সফার করে দিলেন। সেখানে নানা ধরণের মেডিক্যাল টেস্ট করানোর পর রিপোর্ট দেখে ডাক্তার অভিভাবক ডাকালেন। অভিভাবক বলতে তো আছেন শুধু ওর মা-ই। বাবা তো কবেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন।
আকাশের মা খুবই সাদামাটা সহজ-সরল একজন মহিলা। যক্ষের ধন সন্তান দুটির জন্যই তাঁর বেঁচে থাকা। স্কুলে শিক্ষকতা করে মেয়ে পলির স্কুলের খরচ জুগিয়ে খুব কষ্টে কিছু টাকা ছেলেকে পাঠাতে পারেন। অথচ, ডাক্তার সেদিন তাঁকে ডেকে জানিয়ে দিলেন, যার মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি এতদিন এত কষ্ট সহ্য করেও বেঁচে আছেন, কিছুদিন পর যে ছেলে ডাক্তার হয়ে বের হয়ে ওর বাবার স্বপ্ন পূরণ করে দাতব্য চিকিৎসালয় খুলে বিনামূল্যে গরিবের চিকিৎসা করবে আর তাঁদের সকল কষ্ট ঘুচাবে, তার নাকি আর বেশীদিন বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ক্ষীণ!


সেদিন, ডাক্তারের কথা শোনামাত্র জ্ঞান হারিয়েছিলেন কল্পনা বোস। জ্ঞান ফিরলে বিস্তারিত শুনে জানতে পারলেন, তাঁর ছেলের রক্ত ঠিক নেই। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গিয়েছে। বিদেশে নিয়ে যেতে পারলে ভালো হয়, কিন্তু সেই সামর্থ্য তো তাঁদের নেই! আশার কথা, ঢাকা মেডিক্যালেই নতুন ভবনে এখন এই রোগের চিকিৎসা হয়। গ্রামের জমিজমা বিক্রি করে সেখানেই কেবিনে তোলা হলো আকাশকে। আত্মীয়-স্বজনেরা সেভাবে পাশে এসে না দাঁড়ালেও আকাশের বন্ধু-বান্ধব, ছোটভাই বড়ভাইয়েরা যেভাবে পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল, তাতে লড়াকু মনোভাব ফিরে পেয়েছিলেন কল্পনা। ওরাই ক্যাম্পাসে ঘুরে ঘুরে, অনলাইনে যোগাযোগ করে যোগাড় করে ফেললো আরও কিছু টাকা। বাকি টাকা কিস্তিতে দেয়ার সুযোগ মিললো। এরপর বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের বোর্ডের সিদ্ধান্ত মতে কেমোথেরাপি চলছে। চলবে টানা চার মাস। এতে সুস্থ হবার সম্ভাবনা আছে, তবে নিশ্চয়তা নেই। এই সময়টায় আকাশের কাছে ছায়ার মতো পড়ে থাকেন ওর মা। আর থাকে একটি মেয়ে। ওর নাম পাখি।

পাখি মেয়েটার আসল নাম নয়। এটা আকাশের দেয়া নাম। সে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করে এখন ইন্টার্ন করছে। মেয়েটাকে আকাশ প্রচণ্ড ভালোবাসে। জীবনে এই একটা মেয়েকেই ওর ভালো লেগেছে। তবে আজ পর্যন্ত ওরা কেউ কাউকে ছুঁয়ে দেখেনি, নিয়মিত দেখাও করেনা ইচ্ছা করেই। ওদের সম্পর্কটাকে ঠিক প্রেমের সম্পর্ক বলা যায় না, কিন্তু ভালোবাসা আছে।


জীবনে কোনদিন প্রেম-ভালোবাসায় জড়াবে না বলে পণ করেছিলো আকাশ। বাবা মারা যাওয়ার পর মায়ের কষ্টার্জিত অর্থে ডাক্তারি পড়ে আগে মানুষ হওয়া, তারপর ওসব নিয়ে ভাবা যাবে –এই ছিলো ওর ইচ্ছা। অথচ, বিধাতার ইচ্ছে ছিলো ভিন্ন। কেমন না বলে-কয়েই ওর জীবনে একদিন আবির্ভাব ঘটে গেলো পাখির।

আকাশ তখন এমবিবিএস দ্বিতীয় বর্ষে পড়ে। রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে বিছানায় শুয়ে একটি চ্যাটিং ওয়েবসাইটে বন্ধুদের সাথে চ্যাট করা ওর অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলো। সদ্য বাবা হারানোর কষ্ট আর একাকিত্ব ভুলে থাকতে এটা ওর একটা চেষ্টা ছিলো। এক
দিন সেই চ্যাটরুমে ‘অশ্রু সিন্ধু’ নামের একটি আইডির সাথে আলাপচারিতার এক পর্যায়ে হলো বন্ধুত্ব। মেয়েটিও ডাক্তারি পড়ে বিধায় ওর পড়ালেখার খোঁজখবর নিতো, আলাপ হতো ব্যক্তিগত বিষয় নিয়েও। মেয়েটার মিষ্টি কথায় কেমন একটা স্নিগ্ধতা খুঁজে পেলো আকাশ। ওকে ভালো বুঝতো সে। আস্তে আস্তে একটা সময় মেয়েটির প্রতি দুর্বল হয়ে পড়তে থাকলো। প্রতি রাতে একটা নির্দিষ্ট সময় ওর অপেক্ষায় থাকতো আকাশ। না এলে মন খারাপ হতো, নির্ঘুম রাত কাটতো। এভাবে একসময় ফেসবুক আইডি এবং মোবাইল নাম্বার আদান-প্রদান হলো। দুজন আরও কাছাকাছি এলো। আকাশ মেয়েটির নাম রাখলো ‘পাখি’।

পাখির সুন্দর করে বলা কথা শুনে আর ছবি দেখেই আকাশ ওকে ভালোবেসে ফেললো। একদিন বলেও ফেললো সে কথা। কিন্তু পাখি জানালো, আকাশে উড়াল দিতে পাখির সমস্যা একটাই। আর সেটা হলো ধর্ম। পাখি মুসলিম, আর আকাশ হিন্দু। এ সমাজ এই সম্পর্ককে কিছুতেই মেনে নেবে না। অতএব, তাঁদের নাকি দূরে থাকাই ভালো।
অথচ অবুঝের মতো আকাশ বললো, “আমার একাকিত্বের দিনে তুই মানসিক সঙ্গ দিয়েছিস আমাকে। তোকে ছাড়া আমি কিছুই ভাবতে পারি না। এখন ভালোবাসার সম্পর্কটা থাকুক, পরে পরিবারকে ম্যানেজ করে বিয়ে করা যাবে। তখনও যে যার ধর্ম পালন করবো। বলিউডে শাহরুখ-গৌরিকে দেখিস না?”

আকাশ অবাক হয়ে দেখলো, পাখি মেয়েটা আকাশের চেয়েও অনেক বেশি বাস্তববাদী। সে আকাশকে বুঝাতে চেষ্টা করলো। বললো, “ওদের ব্যাপার আর আমাদের ব্যাপার এক না। তোর মা মানবেন? আমার বাবা-মা তো মেনে নেবেই না। এক হয় যদি তুই ধর্ম পরিবর্তন করিস...”

এই শেষের লাইনটি নিয়ে অনেক ভেবেছে আকাশ। ছুটিতে বাড়িতে গিয়ে মায়ের পাশে গিয়ে একদিন সব লজ্জার মাথা খেয়ে মাকে সব খুলেও বলেছে। শুনে মা সরাসরি না করে দিয়েছেন। বলেছেন, “তুই বংশের একমাত্র ছেলে। এমন কাজ ভুলেও করতে যাবি না। তোর ওপর আমার পূর্ণ বিশ্বাস আছে। তবুও যদি কোনদিন এমন কাজ করে বসিস, তবে তুই আমার মরা মুখ দেখবি।”

এরপর আকাশ যা সিদ্ধান্ত নেবার নিয়ে ফেলেছে। সিদ্ধান্তটা এমন যে, মায়ের মনে ব্যাথা দিয়ে সে কিছু করবে না। ওরা দুজন সারাজীবন বন্ধু হয়েই থাকবে। মাঝে মাঝে ফোনে কথা হবে, কদাচিৎ দেখা-সাক্ষাৎও হবে, কিন্তু কেউ কখনও কাউকে আপন করে পেতে চাইবে না। এই ভালোবাসার নাম কি দেয়া যায়? হিন্দু ধর্মে একটা কথা আছে, ফলের আশা ত্যাগ করে যে কর্ম করা হয় তাকে নিষ্কাম কর্ম বলে। তাহলে আকাশদের এই ভালোবাসাকে কি বলা যায়? কামনা-বাসনাহীন ভালোবাসা?


যেদিন আকাশের রোগটা ধরা পড়লো, সেদিন ছিল পাখির অফ ডে। বন্ধু মারফত খবরটা শুনেই হোস্টেল থেকে ছুটে এলো আকাশের কাছে। আকাশ তখন বিছানায় শুয়ে। পাশে কল্পনা। ঘরভর্তি লোকজন। তখনও ওকে কেবিনে তোলা হয়নি। ইচ্ছে করছিল সব বাধা ভুলে দৌড়ে গিয়ে আকাশকে জড়িয়ে ধরে ইচ্ছেমতো কাঁদে। কিন্তু এত লোকজন, বিশেষ করে আকাশের মাকে দেখে সে থেমে গেলো। দরজায় দাঁড়িয়ে নিরবে অশ্রু বিসর্জন করতে লাগলো।

কল্পনা পাখিকে চিনতে ভুল করলেন না। গতবার দূর্গাপূজার সময় আকাশের সাথে ওর বাসায় গিয়ে কল্পনার হাতে তৈরি নারিকেলের লাড্ডু খেয়ে এসেছে সে। মেয়েটি সবদিক দিয়ে লক্ষ্মী। তাঁর ছেলের পছন্দ আছে বলতে হবে। কিন্তু এই পছন্দকে তিনি উৎসাহ দিতে পারেন না। যেমনটি পারেননি মেয়েটির বাবা-মাও। আজ ওকে দেখে এগিয়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে শান্ত করলেন। এরপর সবাইকে নিয়ে বাইরে গেলেন।

আজ গুনে গুনে ১১০ দিন পর আকাশের সাথে দেখা হলো পাখির। দূরে দূরে থেকে ভুলে থাকার চেষ্টা। ধীর পায়ে আকাশের শয্যার পাশে গিয়ে বসলো সে। তারপর শান্ত কন্ঠে বললো, “শয়তান, দূরে আর থাকতে দিলি কই?”

আকাশ ওর দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসতে চেষ্টা করলো। তারপর বললো, “আমি আর বেশিদিন বাঁচবো না শুনে তোকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছিলো রে। এই যে দেখা হয়ে গেলো, এখন মরে গিয়েও শান্তি। যাহ্‌, তোকে মুক্ত করে দিয়ে গেলাম...”

সাথে সাথেই দুচোখ উপচে জল এলো পাখির। হাত দিয়ে আকাশের মুখ ঢেকে বললো, “ও কথা আর ভুলেও মুখে আনবি না। তোকে এতো সহজে মরতে দিচ্ছি না আমরা।”

এরপর থেকে আকাশকে কেবিনে ভর্তি করানো, ডাক্তারদের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখাসহ সব কাজে কল্পনার পাশে থাকে পাখি। কল্পনা প্রথমে বাধা দিয়েছিলেন ওর কষ্ট হবে বলে। কিন্তু পাখি সেকথা শোনেনি। ওর বাবা-মাও আর আপত্তি করেননি। বন্ধুর অসুখে বন্ধু পাশে থাকবে, এতে বাধা দেবার অধিকার কারো নেই।


এরপর টানা ৪৫ দিন কেমোথেরাপি দেয়া হয়েছে। অথচ উন্নতির কোন লক্ষণ নেই। আকাশের শরীর আরও দুর্বল হয়েছে, চোখের নিচে কালি পড়েছে। খুব কষ্ট হয়। আজকাল স্যালাইনের নল শরীরে ঢুকিয়ে শুয়ে থাকতে আর ভালো লাগে না আকাশের। মা আর পাখির মলিন মুখে জোর করে মেকি হাসি ফোটানোর চেষ্টা দেখেও ভালো লাগে না। টানা পরিশ্রমে মায়ের চেহাড়াও খারাপ হয়ে গেছে। রুমে একা থাকাকালীন সময়ে ডাক্তারি রিপোর্ট দেখে ও বুঝেছে, কিছুতেই কোন উন্নতি হচ্ছে না ওর। শুধু শুধু টাকার শ্রাদ্ধ হচ্ছে। রক্ত যোগাড় করতেও এখন হিমশিম খেতে হচ্ছে। অথচ ছেলেকে কিছুই এসব কিছু বুঝতে দেন না মা। মা কি কখনও ছেলেকে ফেলে দিতে পারে?

অনেক ভেবেচিন্তে আকাশ ঠিক করলো, এই যন্ত্রণা থেকে নিজে মুক্তি পাওয়া এবং বাকিদের মুক্তি দেয়ার একটাই উপায়। খুব কষ্টে পাখিকে একটা চিঠি লিখলো আকাশ। তখন ভোর ৪ টা। চিঠিটা বালিশের নিচে রেখে, স্যালাইনের নল খুলে ফেললো। তারপর পাশের চেয়ারে ঘুমন্ত মাকে শেষবারের মতো প্রণাম করে ধীর পায়ে বাইরে বেরিয়ে এলো। করিডোরে কেউ নেই, নার্স দুজন ঝিমুচ্ছে। খোলা বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে সামনে লাফ দিয়ে নিজেকে সে মুক্ত পাখির মতো উড়িয়ে নিতে চাইলো। শেষবারের মতো চোখের কোণে দুফোঁটা অশ্রু জমলো আকাশের।
তারপরেই সব শেষ। কল্পনা আর ছেলের লাশ দেখার সাহস করে উঠতে পারেননি। শুনেই বাকশক্তি হারিয়ে শয্যাশায়ী হয়েছেন। পাখি খবর পেয়েই ছুটে এসে চিঠিটা পেয়েছে। তাতে লেখা-

“আমার পাখি,
নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না রে। তোদের কষ্ট আর দেখতে পারি না। ওদিকে ভিটা-মাটি-সম্পদ সব যদি আমিই শেষ করে যাই, তবে পলির ভবিষ্যৎ কি হবে? তাই ভাবলাম অনেক হয়েছে, আর নয়। এবার বিদায় নেবার পালা।
তুই পারলে মাকে একটু দেখিস, পলি বড় হলে ওর ভালো দেখে একটা বিয়ে দিস। আর আমাকে ভুলে যাবি নাতো? যত দূরেই থাকি না কেন, আমার আকাশ তোর জন্য সর্বদা উন্মুক্ত থাকবে। ভালোবাসা নিস। দেখা হবে অন্য কোন জন্মে, অন্য কোন জগতে। যেখানে আমাদের দুজনের মাঝে কোন বাঁধাই আর বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে না।
ইতি,
আকাশ।”

-দেব দুলাল গুহ

সংলাপ ছাড়াই গোটা একটা ভালোলাগার ছবির গল্প!



গল্পটি দৈনন্দিন ব্যস্ততার মাঝে এক হাসি ভালোবাসা খুঁজে নেয়ার। গল্পটি আর দশটি গল্পের চেয়ে আলাদা। কারণ গল্পটিতে নেই কোনো সংলাপ। কিছু না বলেও অনেক কিছু বলে ফেলা হয় এই গল্পে। এই গল্পটি আজ থেকে আমার অন্যতম ভালো লাগার গল্প।

গল্পের মুখ্য চরিত্র মাত্র দুটি। একটি ছেলে ও একটি মেয়ের গল্প এটি। ওরা বিবাহিত। কিন্তু, দৈনন্দিন জীবনের জীবিকার তাগিদে ব্যস্ততার মাঝে, ওরা একে অন্যের সঙ্গ পায় খুব অল্প সময়ের জন্য। সেই সময়টুকুই ওদের বহু আকংখার, যেন কল্পিত স্বর্গরাজ্যে কাটানো একান্ত কিছু মুহূর্ত!

গল্পের শুরু একটি মেয়েকে দিয়ে। যে মেয়েটি সদ্য বিবাহিত, থাকে কলকাতার এক পুরাতন বাসায়। মেয়েটির কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার চিত্রপট দিয়ে গল্পের শুরু। কলকাতার অলিগলি হয়ে ট্রাম-বাসে চড়ে অফিসে যাওয়া, আছে শব্দ আছে গান কিন্তু নেই কোনো সংলাপ। মেয়েটি যখন অফিসে কাজে ব্যস্ত, ছেলেটি তখন বাসায়, একা। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেয়া, বাজার করা, আবার ঘুমানো। মেয়েটির ফিরতে ফিরতে ছেলেটি ততক্ষণে তার পুরাতন বাইসাইকেলটি নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে। দুজনের দেখা হবার উপায় নেই।

মেয়েটিও ফিরে ছেলেটির মতোই বাসার বাকি থাকা কাজগুলো সারে, স্নান সারে, কাপড়চোপড় গুছায়। তারপর খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। ছেলেটি তখন প্রেসে, পত্রিকা ছাপানোর কাজে ব্যস্ত। তার কাজ রাত জাগার। কাজ করতে করতেই ভোর হয়। ছেলেটি মেয়েটিকে ফোন করে ঘুম ভাঙ্গিয়ে দেয়। মেয়েটি ফ্রিজে রাখা মাছ তরকারি নামিয়ে রান্না করে, স্নান করে পূজো দেয়। এরই মধ্যে ছেলেটি ছুটি পেয়েই ভোরের আলোয় ঘুমন্ত রাস্তা মাড়িয়ে সাইকেলে শরীরের সকল শক্তি লাগিয়ে জলদি বাড়ি ফেরে। এই ফেরায় ভালোবাসা আছে, প্রিয় মানুষটার মুখটা একটিবার দেখার জন্য আকুতি আছে।

ছেলেটি ঘরে ঢুকে দেখে, মেয়েটি কেবল পূজা শেষ করলো। চুলগুলো তখনও ভেজা ওর। এরপর, দৃশ্যপট পাল্টে যায়। মুছে যায় শহুরে শব্দ। ওরা হারিয়ে যায় এক গহীন বনে। সেখানে ওরা দুজন মিলে কিছুক্ষণ একাকী সময় কাটায়। হঠাৎ মেয়েটি ছেলেটির হাতঘড়িতে সময় দেখে অফিসে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়। ছেলেটার মুখ তখন কালো। সেই কালো মুখে হাসি ফুটিয়ে সে মেয়েটির শাড়ি সেফটি পিন দিয়ে আটকে দেয় ওর লাল ব্লাউজে। এক মুখ হাসিময় ভালোবাসা দিয়ে বিদায় দেয় ওকে। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত মেয়েটির দেখা পাওয়া যায়, ততক্ষণ জানালা দিয়ে চেয়ে থাকে। এটাই মনে হয় পৃথিবীর পবিত্রতম ভালোবাসা!

এতক্ষণ যে গল্পটি শুনলেন, সেটি একটি ছবির গল্প। আদিত্যবিক্রম সেনগুপ্তর ব্যাতিক্রমধর্মী ছবিটির নাম 'আসা যাওয়ার মাঝে', ইঙ্গরেজিতে 'Labour of Love'। অর্জন করেছে দেশ-বিদেশে অনেক পুরস্কার। গোটা ছবিতে কোথাও কোনো সংলাপ নেই। তাই শুরুতেই বোরড হয়ে না গিয়ে, ধৈর্য ধরে পুরোটা দেখুন। আমার বিশ্বাস আপনারও ভালো লাগবে। মেয়েটির সাদামাটা চেহাড়া, কপালের লাল টিপ, সুন্দর করে শাড়ি পড়া, চুলের ঐ বেণীর প্রেমে আমি পড়ে গেছি। আপনাকেও প্রেমে পড়ার আমন্ত্রণ।

-দেব দুলাল গুহ