খুঁজুন

Friday, April 23, 2021

লকডাউন বাস্তবায়নে আমি যা করতাম: দেব দুলাল গুহ

১. শপিং মল ও দোকান খোলা থাকলে থাক, কিন্তু আমি যাব না। বেঁচে থাকলে করোনাকালের পরেও নতুন কাপড় পরতে পারবো। কিন্তু করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হলে এবারই হবে শেষ নতুন জামাকাপড় পরা। তাই, যারা দলবেঁধে কেনাকাটা করতে যাবেন, তারা একসাথে কাফনের কাপড়টাও কিনে নিয়ে আসলে সুলভে কিছুটা ছাড়ে পেলেও পেতে পারেন। কিনে রাখেন, অতি দ্রুতই কাজে লাগবে। শুধু নিজের জন্য না, পরিবারের প্রত্যেকের জন্য একটি কিনবেন। সাথে ব্যাংক থেকে কিছু টাকা তুলে বাসার খোলামেলা কোনো একটা জায়গায় রেখে দিবেন। কেননা, যদি আপনি ও আপনার পরিবারের সবাই শ্বাসকষ্টে ভুগে মরে থাকেন বাসায়, যাতে কেউ অন্তত আপনাদের দাফনের কাজটা করতে পারে সেই ব্যবস্থা করে রাখাই ভালো। কাজেই, ঈদের শপিং করতে বের হলে এই দুটি বিষয় নিশ্চিত করে বের হবেন। ঠিক আছে?


 .

২. এখানে সরকারের দোষ দেওয়া যাবে না। দোকানমালিকদের দাবির মুখেই খুলে দিতে বাধ্য হয়েছে সরকার। তাদের নাকি জীবিকা হুমকির মুখে! আমার মনে হয় না বাংলাদেশে এত গরিব দোকানদার বা ব্যবসায়ী আছেন, যারা অন্তত দুইটা সপ্তাহ কোনোমতে ডাল আর আলুভর্তা দিয়ে ভাত খেয়ে ঘরে থাকতে পারবেন না। দোকানের কর্মচারীদের দুই সপ্তাহের খোরাক দেওয়াটা তাদের দায়িত্ব। তবে এক্ষেত্রে সরকারেরও দায় আছে। লকডাউনের আগে এইসব শ্রমিক, রিক্সাচালক, কর্মচারীদেরকে দুই সপ্তাহের রেশন দিয়ে তারপর ঘরে থাকতে বললে লকডাউন আরও ভালো কার্যকর হতো বলে মনে করি। বাংলাদেশের এখন সে সামর্থ আছে। প্রতিটি এলাকার সামর্থবান মানুষরাও এগিয়ে আসতে পারতেন। দানে সম্পদ কমে না, বরং বাড়ে। ঠিক কিনা? 

.

৩. আমি নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে থাকলে সবার আগে দেশের নাগরিকদের একটা নির্ভুল তালিকা (ডেটাবেজ) করতাম এনআইডি কার্ড দেখে। কার্ডে সবার পেশার নির্ভুল তথ্য রাখা নিশ্চিত করতাম। নিশ্চয়ই প্রায় সবারই বর্তমানে সিমকার্ড আছে। প্রতিটি সিম থেকে নগদ বা বিকাশ এ্যাকাউন্ট খুলাতাম। নিশ্চিত করতাম এক আইডি দিয়ে একাধিক এ্যাকাউন্ট যাতে খোলা না হয়। এরপর খেটে খাওয়া অসচ্ছল পরিবারের অন্তত একজনের একাউন্টে দুই সপ্তাহের খোরাকি ভাতা পাঠিয়ে দিতাম। সরকারি তহবিল থেকে এতো টাকার যোগান দেওয়া সম্ভব নাহলে সামর্থবান ব্যবসায়ী, দলীয় নেতা, বিত্তবানদের থেকে অর্থ সংগ্রহ করে একটা ফান্ড করতাম। খুব কঠিন কাজ নয় এটা। ইচ্ছা, সততা ও আন্তরিকতা থাকলেই সম্ভব। এভাবে দিলে দুর্নীতি করার বা মেরে খাওয়ার সুযোগ কম থাকবে। এরপরেও একটা হটলাইন থাকবে, যেখানে কেউ না পেলে এনআইডি নম্বরসহ অভিযোগ দেবে। এভাবে আগে সহায়তা দিয়ে তারপর লকডাউন দিলে সবাই সেটা মানতো। না মানলে আমি কড়া ব্যবস্থাও নিতে পারতাম। এই মুহূর্তে কড়া লকডাউনের বিকল্প নেই। জরুরি প্রয়োজনে বের হলে স্বাস্থ্যবিধি মেনে মাস্ক পরার, বাকি সময় ঘরে থাকার বিকল্প নাই। প্রয়োজনে পুলিশ কেন, সেনাও নামাতে পারবেন এরপর না মানলে। কিন্তু এখন ফাঁকিবাজটাও পুলিশ ধরলে বলবে কেনাকাটা করতে যাচ্ছি অথবা বলবে ঘরে বসে থাকলে খাব কি তাই জীবিকার সন্ধানে বের হয়েছি। তখন আর এসব বলার সুযোগ পাবে না। বললেই এনআইডি চেক করে বলা যাবে, আপনি না দুদিন আগেই ভাতা নিলেন? লকডাউনের আগে এই টাকায় কেনাকাটা করেননি কেন? আরেকটা কাজ করতাম, মাস্কের বিরুদ্ধে যারাই বয়ান দেবে, যারাই করোনাভাইরাসকে পাত্তা না দিয়ে বয়ান দেবে, তাদেরকেই সাথে সাথে আইনের আওতায় আনতাম। এভাবে দুই থেকে তিন সপ্তাহ বা এক মাসের কঠোর লকডাউন দিলে করোনার প্রকোপ কমে আসতো। 

.

৪. যেভাবে করোনাভাইরাস ছড়াচ্ছে, মাস্ক ছাড়া যেভাবে মানুষ ঘুরে বেড়াচ্ছে তা দেখে শংকা হয়-- হয়তো বাঙালি জাতিটাই বিলুপ্ত হয়ে যাবে এভাবে চলতে থাকলে! কেননা সচেতন মানুষও একদিন না একদিন তাদের দ্বারা আক্রান্ত হবেই। কেননা করোনা শুধু ড্রপলেটের মাধ্যমে নয়, বরং করোনাভাইরাস বাতাসের মাধ্যমেও ভেসে ভেসে দূরদূরান্তে ছড়ায়। এভাবে চলতে থাকলে খুব শীঘ্রই বাইরের দেশগুলো আমাদেরকে ভিসা দেওয়া বন্ধ করে দেবে। আমাদের বাণিজ্য, পড়ালেখা, ভ্রমণ সব নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়বে। কারণ কেউই খাল কেটে কুমির (ভিসা দিয়ে ভাইরাস) আনতে চাইবে না। 

.

৫. খুব আশার খবর, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে পরীক্ষিত বন্ধু রাশিয়া তাদের টিকা স্পুটনিক-ভি উৎপাদনের ফর্মুলা আমাদেরকে দিতে রাজি হয়েছে। আমরা যৌথ মালিকানায় আমাদের দেশে টিকা উৎপাদন করতে পারবো, দেশের চাহিদা মিটিয়ে তা রপ্তানি করে রাশিয়াকে লভ্যাংশ দিয়ে নিজেরাও লাভ করতে পারবো। এটাই আমাদের লাভ। আর এখানে রাশিয়ার লাভ আমাদের দিয়ে টিকা উৎপাদন করিয়ে নেওয়া৷ কেননা আমাদের সস্তা শ্রমিক আছে, ঔষধশিল্পে আমরা অনেক এগিয়ে। দ্রুত উৎপাদনে যাওয়া গেলে দ্রুত নিজেরাও নিরাপদ হতে পারবো, রপ্তানি করে আয়ও করতে পারবো। রাশিয়ার এই টিকার দাম প্রতিটি ১০ থেকে ২৭ ডলার, কার্যকারিতা ৯১.৬%। যেখানে অক্সফোর্ড -এ্যাস্ট্রোজেনেকার টিকা যা ভারতের সেরাম উৎপাদন করছে, তার দাম ৪ ডলার, কার্যকারিতা ৮১.৩০%। আবার চীনের সাথে মিলে এই অঞ্চলে টিকার মজুদ করতেও বাংলাদেশ সম্মতি দিয়েছে, যা জরুরি প্রয়োজনে কাজে লাগবে। 

.

৬. টিকার মজুদ দ্রুত শেষ হয়ে আসছে। আগে মানুষ টিকা নিতে অনাগ্রহী ছিলো নানা কারণে, এর মধ্যে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ভয় যেমন ছিল, আবার ধর্মব্যবসায়ী মূর্খ বক্তাদের বিভ্রান্তিকর বক্তৃতাও ছিলো। এখন মানুষ বুঝতে পারছে টিকার আবশ্যকতা। তাই দ্রুত টিকা শেষ হচ্ছে। আমার মনে হয় টিকার এই সংকট হতো না যদি ভারত প্রতিশ্রুত টিকা সময়মতো দিতে পারতো। ভারত সেটা পারছে না, তার কারণ সবাই আগে নিজের উদরপূর্তি করে তারপর অন্যকে দেয়, তা সে যত বড় বন্ধুই হোক। নিশ্চয়ই যেকোনো চুক্তির মতো এই চুক্তিতেও কিছু টার্ম অ্যান্ড কন্ডিশন ছিল এবং নিজের প্রয়োজন না মিটিয়ে কাউকে দেবে না এমন কথাও হয়তো লেখা ছিল। তাই বাংলাদেশ ভারতকে বাধ্য করতে পারছে না। ঐদিকে ভারতেও হঠাৎ করোনার প্রকোপ বেড়েছে। ভোটের হাওয়ায় প্রচারণা একটা কারণ, ঐদেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবিকা এবং কুম্ভমেলার মতো লোকসমাগমও কারণ। যে কারণেই হোক, ভারতের নিজেদের নাগরিকদের জন্যই এখন টিকা দরকার। তারপরেও ভারত টিকা দিতো, মোদিকি নিজেই ডিরেক্ট অর্ডারে দিতেন। কিন্তু প্রথমত তিনি বাংলাদেশ সফরের সময় আমাদেরই একটা অংশ তাঁকে আসতে দেবো না বলে ও জ্বালাও-পোড়াও করে  তাঁকে ও তাঁর দেশকে অসম্মানিত করেছি।  এটা এখানে একটা বড় প্রভাব ফেলেছে বলে আমার মনে হয়। কেননা, যে পিএম করোনাকালের পর প্রথম বিদেশ সফরেই নিজের রাষ্ট্রীয় বিমানের প্রথম ফ্লাইটেই বাংলাদেশ এলেন, বিশ্বের উন্নত দেশগুলোও যখন চেয়ে টিকা পাচ্ছিলো না তখন পেয়েছিলাম আমরা, পেয়েও সেই টিকার বদনাম করতেও ছাড়েনি আমাদেরই সেই অংশটি, গুজব রটিয়েছে ভারতের টিকায় শুকরের চর্বি আছে ইত্যাদি বলে! এখানে তাই বন্ধুত্ব নিয়ে টিটকারি করারও কিছু নেই, কেননা নিজের স্বার্থ অক্ষুন্ন রেখেই সবাই পরের জন্য করার চেষ্টা করে। ইউরোপীয় ইউনিয়নও টিকা আটকে দিয়েছিল, বলেছিল আগে তাদের নাগরিকদের না দিয়ে বাইরে দেবে না। আমাদের ভাগ্য বরং ভালো যে ভারতেও ঐ টিকা উৎপাদন হচ্ছে এবং ভারতের সাথে আমাদের সম্পর্ক বর্তমানে অন্য যেকোনো সময়ের(মুক্তিযুদ্ধ ও '৭৫ এর পর) চেয়ে ভালো। তাই দ্রুতই সঠিক সময়ে আমরা টিকা পেয়েছি। ভারতের পিএম ও সেনাপ্রধান এলেন ফ্রি টিকা উপহার হিসেবে নিয়ে, আর আমরা তাদেরকে আসম্মানিত করলাম। আমাদেরকে টিকা দিয়ে এমনিতেও নিজ দেশে বিরোধী দলের চাপের মুখে ছিলেন মোদিজি, বলা হচ্ছিল দেশের মানুষ পায় না আর তিনি বাইরে বিলাচ্ছেন! টিভি দেখেন, ভারতের করোনা মহামারির অবস্থা আসলেই ভয়াবহ। সুতরাং, সরকার খুবই ভালো কাজ করেছে রাশিয়ার টিকার উৎপাদনের চুক্তি করে। মানতেই হবে কূটনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক এগিয়েছে। এখন দ্রুত উৎপাদনে যাওয়া আবশ্যক। যতদিন তা করা যাচ্ছে না, ততদিন ভারতের থেকে আনার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি রাশিয়া থেকেও ভ্যাক্সিন কিনে আনা দরকার। 

.

৭. কমপক্ষে ৮০% জনগণকে করোনা পরীক্ষা করিয়ে টিকার আওতায় আনা গেলে করোনা থেকে মুক্তির আশা করা যাবে। তার আগ পর্যন্ত কঠোর লকডাউনের বিকল্প নেই। বেঁচে থাকাটা জরুরি। বেঁচে থাকলে আবার অর্থনীতির চাকা ঘুরবে। ব্যাংকে টাকা ফেলে রেখে কি হবে যদি আমার মানুষই না বাঁচে? সহায়তা দিয়ে কঠোর লকডাউন, প্রয়োজনে ১৪৪ ধারা জারি, ভ্যাক্সিন কিনে এনে দ্রুতই ৮০% নাগরিককে দিয়ে ফেলা দরকার। আর সবকিছুর আগে দরকার দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন, জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারকে নিয়ন্ত্রণে আনা, অর্থনীতকে সচল রাখা। সর্বোচ্চ নেতৃত্বে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একা সৎ, পরিশ্রমী, কর্মঠ হলে হবে না। মাঠ পর্যায় পর্যন্ত সৎ, যোগ্য, পরিশ্রমী, নীতিবান লোকদের খুঁজে বের করে সঠিক চেয়ারে বসাতে হবে। 

তাহলেই করোনাকে ভয় নয়, করবো আমরা জয়।  

জয় বাংলা। 


দেব দুলাল গুহ নিপুণ

3 comments:

  1. ❤️❤️ গত দু'সপ্তাহ আমরা যে লকডাউন বা কঠোর বিধিনিষেধ দেখেছি তা আর দেখতে চাই না। দাদা আপনি যথার্থ লিখেছেন মাস্ক ছাড়া যেমন ইচ্ছে তেমন করে ঘুরে বেড়ানো বাঙালি জাতিই বিলুপ্ত হয়ে যাবে। ইদ উপলক্ষে হয়তো পর্যটন কেন্দ্র গুলো খুলে দিবে তখন দেখা যাবে উপচে পরা ভিড় অথচ তারা লকডাউনে গরীব না খেয়ে মরবে ইত্যাদি বলে বেড়িয়েছে।

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ। কার্যকর কঠোর লকডাউন চাই।

      Delete