খুঁজুন

Sunday, January 13, 2019

আমি কি অনেক বড় পাপ করে ফেললাম?

ফরিদপুরের নামকরা এক হোটেলের নিচের একটা সেলুনে ছোটবেলায় বাবার সাথে যেতাম চুল কাটাতে। চুল কাটানোকে বরাবরই আমার খুব বিরক্তিকর কাজ বলে মনে হয় যদিও। সেলুনটা আমার কাকার বন্ধুর, আমাদের বাড়ির পাশেই বাড়ি। আমি গেলেই কাকা অথবা তার বোনের জামাই অনেক সময় নিয়ে যত্ন করে আমার চুল কাটতো। কাকা আছেন, কিন্তু তার বোনের জামাই বেঁচে নেই। সেই বিধবা পিসি এসেছিলেন বাসায়। পা ফুলে ঢোল হয়ে আছে তার, নাড়াতে কষ্ট হচ্ছে। সেই পা নিয়েই খুব কষ্টে হেঁটে হেঁটে এসেছেন।
.
আমার মা ডিএইচএমএস ডাক্তার, মানে হোমিও ডাক্তার। এলাকায় বেশ নামজশ আছে, তবে খুব সামান্য পয়সায় ওষুধ দেয় বলে কেউ কেউ তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে। ১৮ বছর ফরিদপুর শ্রীঅঙ্গন দাতব্য চিকিৎসালয়ে মাত্র ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা মাসিক বেতনে সেবা দিয়েছেন। রোগীপ্রতি ৫টাকা ভিজিট ছিলো, যে পারতো না সে দিতো না। ওষুধ সরবরাহ করতো বাজারের মারোয়ারিরা। কিন্তু বাবা মারা যাওয়ার পর এলাকার প্রভাবশালীরা মন্ত্রী লোক পরিচয় দিয়ে সেখান থেকে আমার মাকে নানাভাবে অপমান করে সরিয়ে অন্য কাউকে বসানোর চেষ্টা করেছে। ঢাকায় থাকতে মা আমার কাছে এসব বলতো না, কিন্তু ফরিদপুর ফিরে দেখে প্রতিবাদ করেও ফল না পেয়ে নিজে থেকেই মাকে বসতে মানা করেছি।
.
তো, সেই দাতব্য চিকিৎসালয়ের সুবাদে মা দুঃস্থ জনগণের কাছে সেই ৫টাকা ১০টাকার ডাক্তারই রয়ে গেছে৷ এখন খুব সীমিত পরিসরে বাসাতেই টুকটাক রোগী দেখে, শিক্ষকতার পাশাপাশি। মা নিজেও অসুস্থ। অনেক সময় দেখি পাশের বিহারী কলোনির থেকে মহিলারা আসে ওষুধ নিতে। নেওয়া শেষে মা যখন খুব কষ্টে ৩০ টাকা চায়, তারা তখন কোছের ভেতর থেকে ১০টাকা বের করে বলে বাকি টাকা পরে দেবো। বাকির নাম তো ফাঁকি, কেউ কেউ দেয়, যারা দেয় না মাও ভুলে যায়। সামর্থবান কেউ কেউ এসেও বলে, 'ছেলের জন্যে চিপস কিনতে আইছিলাম দুকানে, তাই ১০টাকা আছে। কাকি পরে দিবানে..'
.
আমার মায়ের ওপর আমার তখন রাগ হয়। সে মুখ ফুটে বলতেও পারে না যে এই ওষুধ তো আর ফ্রিতে কেউ দেয় না, বাসার ওষুধ আমাকে বাজার থেকে কিনে আনতে হয়।  আসা-যাওয়াতেই তো ১০ টাকা অটোভাড়া অথবা ৪০ টাকা রিক্সাভাড়া চলে যায়! অন্য ডাক্তাররা যখন ১০০-২০০ টাকা ভিজিটের কমে রোগীই দেখেন না, এমবিবিএস ডাক্তারের ভিজিট যেখানে কমপক্ষে ৫০০ টাকা, সেখানে তিনি ওষুধ দিচ্ছেন ১০ টাকায়, যা খেয়ে ওসুখ নিশ্চয়ই ভালো হয়, নাহলে আবার আসে কেন?
.
বাবাকেও একই কাজ করতে দেখেছি। আমার দাদু প্রয়াত কালীপদ গুহ ছিলেন বড় ব্রিজের ঢালের নামকরা শুকু ডাক্তারের কম্পাউন্ডার। তবে এটা তাঁর মূল পেশা ছিলো না। জমিদারি সামলানো আর অন্য কাজের পাশাপাশি এটা করতেন সেই স্বাধীনতাপূর্বকালে। সেখান থেকে তিনিও কিছু বিদ্যা দিয়ে যান বাবাকে। বাবা চাকরি ওকালতি লেখালেখির পাশাপাশি বিকেলে এলাকার কেউ এলে ফ্রিতেই তাকে ওষুধ দিতো। এমনকি ফরিদপুর শহরের অনেক বড় বংশের মহিলারা বাবার বুদ্ধি নিয়ে ছেলেসন্তানের মা হয়েছেন। কিন্তু আমাদের দুঃসময়ে তাদের কেউ পাশে এসে দাঁড়ায়নি। তাই এখন মন চাইলেও মাথা সায় দেয় না সমাজকর্মে।
.
সেই পিসিও মাঝে মাঝেই ওষুধ নিয়ে টাকা না দিয়ে চলে যান। আজকেও ১০টাকা নিয়ে এসেছেন। মাকে জিজ্ঞেস করলাম, কেন তুমি টাকা চাও না? মা বললো, ওর স্বামী তোকে খুব ভালোবাসতো। তোর বাবা থাকতে তুই চুল কাটাতে গেলেই কাটানো শেষে তোর জন্য খাবার কিছু নিয়ে আসতো। আমি বললাম, সে হয়তো বাবা তার কোনো বড় উপকার করেছিলেন তাই। মা বলে, ওর দুই মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। কিন্তু ছেলেটা চুল কাটিয়ে ভালো পয়সা পেলেও মাকে দেখে না। খুব কষ্টে সে একটা এনজিওতে চাকরি করে খায়। ওর মতো আমিও তো একটা সময় খুব কষ্টে কাটিয়েছি, তাই আসলে আর না করতে পারি না। কষ্টের দিনেই ফিরাই নাই, আর এখন তো তুই চাকরি করিস! পাশের আরেক মহিলা ডাক্তারের কাছে যেতে বললেও যায় না, কারণ ঐ ওষুধে নাকি কাজ হয় না এবং ডাকাতি দাম রাখে।
.
এই কথা শোনার পর আমার কী করা উচিত আমি বুঝতে পারছি না। মাকে বললাম, ১০ টাকা দিয়ে তো অটোতে আসা-যাওয়ার খরচ হবে, বাকিটা? মা বললো, থাক বাবা, এনে দিস। এই বলে মা তাকে ওষুধ খাইয়ে দিলেন একটু, বাকিটা কাল এনে দিতে হবে। আমাদের কথা মনে হয় তিনি শুনে ফেলেছেন দূর থেকে। তাই যাবার আগে মাকে বলে গেলেন, বাকি টাকা ওষুধ নেওয়ার সময় দিয়ে যাবেন।
.
সেই থেকে আমার মনটা খারাপ হয়ে আছে।
আচ্ছা, আমি কি অনেক বড় পাপ করে ফেললাম?

Saturday, January 12, 2019

শফী হুজুর, জাতির কাছে আপনার ক্ষমা চাওয়া উচিত

হুজুর ফতোয়া দিয়ে বলেছেন, মেয়েদেরকে স্কুল-কলেজে পাঠানো যাবে না। পরক্ষণেই আরেকটু দয়া দেখিয়ে তিনি বলেছেন, যদি দিতেই হয়, তবে বড়জোর ফোর-ফাইভ পর্যন্ত পড়ানো যেতে পারে। শুধু বলেই ক্ষান্ত হননি তিনি, বরং জুম্মা নামাজ শেষে ১৫ হাজার ধর্মপ্রাণ মুসল্লীকে তিনি এই কথার ওয়াদা করিয়ে তবে ছেড়েছেন! (সূত্রঃ সমকাল)
.
এখন, এই ১৫ হাজার লোকের প্রত্যেকের যদি একটি করেও মেয়ে থাকে আর তারা যদি ওয়াদা পালন করেন অক্ষরে অক্ষরে, তবে এদেশে রোহিঙ্গাদের মতো আরও ১৫ হাজার অশিক্ষিত মা তৈরি হবে, যাদের কাজ হবে শুধু ঘরের চার দেয়ালের ভেতর থেকে একের পর এক সন্তান জন্ম দেওয়া, তারপর তাদেরকে আধুনিক সুশিক্ষায় শিক্ষিত করতে না পেরে অনেকটা নির্বোধ বানিয়ে গড়ে তোলা। এমনিতেই বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের পেট থেকে এই বছরেই শুধু ৫০ হাজার সন্তান আসছে বলে জানা গেছে। তারা শুধু পরের দেওয়া ভিক্ষারটা খাওয়া ঘুমানো আর সন্তান জন্ম দেওয়া ছাড়া আর কিছু করে কিনা জানা নেই। জন্মনিরোধী পিল দিলেও নাকি তারা সেটা ছুড়ে ফেলে দেয়! কী চমৎকার, আমরাও মনে হয় ওদের মতো অকর্মণ্য হয়েই বেড়ে উঠতে দেখতে যাচ্ছি আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মকে!
.
আজকালকার মেয়েদেরকে জানতে টিভি দেখতে বলে মুরুব্বি আরও বলেছেন, ক্লাস ফোর-ফাইভের বেশি পড়াইলে নাকি মেয়ে আর তার বাপের থাকবে না, 'টানাটানি করে অন্য পুরুষ তাকে নিয়ে চলে যাবে'! কথাটা শুনেই কেমন গা জ্বলে উঠলো। ভদ্র সমাজে ভেগে যাওয়া বলতে বুঝি, এক পুরুষ (স্বামী) কে ছেড়ে অন্য পুরুষের সাথে ভেগে যাওয়া। কিন্তু বাবার থেকে আবার 'অন্য পুরুষ' নিয়ে যায় কীভাবে?
.
এই মুরুব্বির লোকজন যখন ঢাকা দখল করতে এসে শাপলা চত্বরে অবস্থান নিয়েছিলো, আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম তখন কড়া ভাষায় তাদের সমুচিত জবাব দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, বিনয় আর ভদ্রতাকে দুর্বলতা ভাবা ঠিক না। তিনি তাদেরকে পালটা আল্টিমেটাম দিয়ে দৃঢ় কণ্ঠে বলেছিলেন, সময় থাকতে ফিরে না গেলে আগামীতে ঘর থেকেই বের হতে দেওয়া হবে না। কী দারুণ নিপাট ভদ্রলোকটি দেশের প্রয়োজনে কী ভীষণ হুংকারটিই না দিতে পেরেছিলেন!
.
আজ সৈয়দ আশরাফ নেই। তাঁর মতো একজনকে খুব মিস করি, যিনি কড়া ভাষায় তাকে জবাব দিতে পারবেন, যিনি দেশকে আবার সেই বেগম রোকেয়ার 'অবরোধবাসিনী'র যুগে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চান। যে দেশে একজন মহিলা রেকর্ড চতুর্থবার দেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর মানুষ হয়েছেন স্বীয় যোগ্যতায়, যে দেশের স্পীকার একজন মহিলা, সে দেশে কী স্বাভাবিকভাবেই না এখানে এসব কথা বলেও পাড় পেয়ে যাওয়া যায়! হিসেবটা মনে হয় খুব জটিল। তাদেরকেই আজকাল বেশি দরকার মনে হয় আমাদের!
.
হুজুর, জাতির কাছে আপনার ক্ষমা চাওয়া উচিত।