মনে হচ্ছে যেন সেই আলিফ লায়লার যুগে ফিরে গেছি!
"কতসব নতুন কাহিনী,
মনভরে দেয় তার বাণী!
কতযুগ পেরিয়ে গেছে,
তবু নতুন রয়ে গেছে..."
ঝিরঝির চ্যানেলের তুলনায় ৫ মিনিটের বিজ্ঞাপনের পর ২-৩ মিনিট নাটক/সিনেমা/খবর! সেই ভালো, সেই ভালো! এত চ্যানেল কেন! শুধু বিটিভি কেন নয়?
--এমনটা বলে বেশ কিছু হাহা রিয়্যাক্ট আমি আদায় করতেই পারতাম। কিন্তু ভাঁড় হতে কেন যেন ইচ্ছা করছে না আমার আজ। বিদেশী চ্যানেল বন্ধের কোনো যুক্তিযুক্ত কারণ পাচ্ছি না আমি। সিরিয়ালের বিরুদ্ধে আমিও, কিন্তু সেটা চ্যানেল বন্ধ করে দিয়ে নয়। ঐ চ্যানেলগুলো দেখে যেমন ঝগড়া শেখা যায়, আবার এটাও ঠিক যে ঐ নিয়ে ব্যস্ত থাকলে ঘরে অনেক ঝগড়া-অশান্তি কমেও আসে।
খেলা? খেলা বাদ? শুধু একটি দেশী চ্যানেল দেখব এই ডিজিটাল যুগে? আর ডিসকভারি/ ন্যাট জিও চ্যানেল? দেখব না? বাচ্চারা কার্টুন দেখবে না? ভিন্ন ভাষার চ্যানেল দেখব না, ভিন্ন কালচারের সাথে পরিচিত হব না? নতুন কিছু শিখব কীভাবে? ভালো কিছু করার প্রতিযোগী মনভাবে আসবে কী করে যদি 'দ্বার বন্ধ করে দিয়ে ভ্রমটাকে রুখি'?
আচ্ছা, বিবিসি, সিএনএনও দেখবো না? আমাদের ইংরেজি উচ্চারণ, শোনা, বলা --এসব ফ্লুয়েন্ট করার সস্তা এই পথটাও বন্ধ থাকবে? কেন? এসব চ্যানেলের কী দোষ?
মূল দাবিটা কী? বিদেশী চ্যানেল আমাদের দেশে দেখাতে হলে বিজ্ঞাপনের জন্য আমাদেরকে টাকা দিতে হবে? বেশ ভালো কথা। তেমনটা হলে আমাদের প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হবে। দেশ উন্নত হবে আরও। কিন্তু তারা যদি না দেয়, যদি বলে থাকো তোমরা একজন ঘরে হয়ে.. দেইখো না আমাদের চ্যানেল, যদি ঘরে ঘরে গিন্নীরা বিদ্রোহ শুরু করে, যদি টিভিতে সিরিয়াল-সিনেমা-খেলা-নাটক নিয়ে ব্যস্ত মানুষগুলো বিনোদনের অভাবে এই করোনাকালে গৃহবন্দী হয়ে আত্মঘাতি হয়ে ওঠে? সেই শুধু বিটিভির যুগের মতো আমাদের নাট্যশালা, প্রেক্ষাগৃহ বা সিনেমাহলগুলো অতোটা মুখরিত নয় এখন; সেই আমলের মতো মানের ছবি, নাটকও কতটা দেখতে পাই আমরা তা নিয়ে মতভেদ আছে। তাহলে মানুষ যাবে কোথায়, দেখবে কী আর মনটা ভালো রাখবে কী করে হাজারটা সমস্যাময় জীবনে?
নাকি সমস্যাটা বিদেশী সংস্কৃতি, ভাষা আর খোলামেলা পোশাকে? আমরা কি দেশটাকে আফগানিস্তান বানাতে চাইছি? নিশ্চয়ই না? আচ্ছা, পর্ণসাইট বন্ধ করে কি সেগুলো দেখা ঠেকানো গেছে? ভিপিএন কি উধাউ হয়ে গেছে পৃথিবী থেকে? ইয়াং জেনারেশন কি ভিপিএন দিয়ে পাবজি খেলছে না? অবিবাহিত তরুণ ইন্টারনেটে কিছু দেখবে না, টিভিতেও কিঞ্চিত খোলামেলা পোশাক দেখবে না, তাহলে কী করবে? পাশের বাড়িতে গিয়ে ঝাপ দেবে, নাকি ধানক্ষেতে গিয়ে অপেক্ষা করবে? নাকি এগুলো বন্ধ করলেই তাদের যৌন চাহিদা কমে যাবে? নাকি আমরা চাইছি বাল্যবিবাহকে প্রমোট করে দেশকে জনসংখ্যার ঘনত্বে ১নং থেকে বিশ্বের সর্বোচ্চ জনসংখ্যার দেশে উন্নীত করতে?
একইভাবে বর্ডার দিয়ে অবৈধভাবে মোবাইল সেট যাতায়াত বন্ধ না করে শুধু নিবন্ধনের নামে সেটপ্রতি প্রায় ১০ হাজার টাকা অতিরিক্ত খরচ করালে দেশ প্রযুক্তিতেও পিছিয়ে যাবে। কেননা এত দাম দিয়ে উন্নত প্রযুক্তির পণ্য কেনা অনেকের পক্ষেই সম্ভব নয়। নিবন্ধনে জোর দিতেই হয় যদি, এসব পণ্যে ভ্যাট-ট্যাক্স সহনীয় পর্যায়ে রাখা ভালো। আধুনিক বিশ্বে প্রযুক্তিতে এগিয়ে যাওয়ারও কোনো বিকল্প নেই। ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো সমাজের আয়না। এগুলোকেও একেবারে বন্ধ করা উচিত হবে না।
বৈশ্বায়নের এই যুগে তথ্যপ্রবাহ, সংস্কৃতির আদান-প্রদান, বিনোদন, প্রযুক্তি, ভাষা ইত্যাদিকে সীমিত করে কোনো জাতি উন্নতির শিখরে উন্নীত হতে পারবে না, একঘরে হয়ে থাকতে হবে। অন্যদের চ্যানেল আমরা না দেখলে, অন্যদের পণ্য আমরা না কিনলে ওরাও আমাদের চ্যানেল দেখতে ও পণ্য কিনতে উৎসাহী হবে না। প্রতিযোগিতামূলক বাজারে আমাদের বরং কীভাবে অন্যদের চেয়েও ভালো মানের শিক্ষণীয়, বিনোদনমূলক, নিউজ বেইজড চ্যানেলগুলো তৈরী করা যায়, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। দেশীয় সিনেমাহলগুলোতেও বিদেশী সিনেমা দেখালে প্রতিযোগিতা বাড়বে। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে, প্রকৃত গুণীজনের মূল্যায়ন করতে হবে। ভালো কাজ হলে বাইরের দেশেও আমাদের চ্যানেল দেখবে। যেমনটা দেখে ওরা আমাদের মোশাররফ করিম-চঞ্চল চৌধুরীর নাটক ইউটিউবে। ইউটিউব, নেটফ্লিক্স যেমন চালু রাখতে হবে, তেমনি চরকি, বায়োস্কোপ, হইচই ইত্যাদিও চালু থাকবে। যার বিজ্ঞাপন দেখতে আপত্তি নাই সে টিভি চ্যানেল দেখবে (বিজ্ঞাপনের মাত্রাও কমিয়ে আনা আবশ্যক, কেননা বিজ্ঞাপন বিরতি আজকাল বিজ্ঞাপন বিরক্তির কারণ হয়), যে বিজ্ঞাপনে আগ্রহী নয় সে নেটফ্লিক্স, অ্যামাজন প্রাইম, হইচই দেখবে। প্রয়োজনে ভালো আর মন্দের, উত্তম আর অধমের পার্থক্য বুঝিয়ে দিতে হবে, কিন্তু কিছুতেই ব্যাক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা ঠিক হবে না।
শেষ কথা হল, বিদেশী চ্যানেল বন্ধ নয়, বরং কীভাবে কেবল সেবার মান আরও উন্নত ও গ্রাহকবান্ধব করা যায় সেদিকে মনযোগ দিতে হবে। সারা বিশ্বের খবর, বিনোদন, সংস্কৃতি ইত্যাদির অবাধ প্রবাহ থাকতে হবে দেশে। সুস্থ বিনোদনের উৎসগুলোকে সচল রাখতে হবে। 'অসুস্থ' বলেও মৌলবাদী, আফগানি চেতনা বাস্তবায়ন করা যাবে না। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে বাঙালিরা যেই সংস্কৃতিকে লালন করে আসছে, তার চর্চা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি অন্য সংস্কৃতিগুলিকেও দেখার ও জানার সুযোগ রাখতে হবে। বাংলাদেশের অভূতপূর্ব উন্নয়নের এই অগ্রযাত্রালগ্নে আমরা আফগানিস্তানের পথে নয়, বরং ইউরোপ-আমেরিকা, রাশিয়া-ভারতের পথে হাঁটতে চাই।
জয় বাংলা।
লেখা: দেব দুলাল গুহ।